মা-বাবা হলেন সন্তানকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে সমাজকে উপহার দেওয়ার প্রথম কারিগর ও সেরা শিক্ষক। মা-বাবার প্রতিটি আচরণই সন্তানের জন্য শিক্ষা। সন্তানের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে মা-বাবার জীবনাচার। মা-বাবা সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ মানস গঠনে আশীর্বাদ ও অভিশাপ—দুই রূপেই আবির্ভূত হতে পারেন। উত্তম মা-বাবা সন্তানদের জীবনে বড় নিয়ামত। তাঁরা সন্তানদের জীবনের কোনো ক্ষেত্রে হেরে গেলেও হারিয়ে যেতে দেন না। উত্তম মা-বাবা সন্তানদের শেখান জীবনে হারজিত মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। জীবনের এদের উপস্থিতি অবিচ্ছেদ্য। বর্তমান সমাজে সন্তানের আত্মহত্যা, হতাশা, বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, কুসঙ্গ ও জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া ও হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবা সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করা অসংগত নয়। জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে মা-বাবার কিছু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা উচিত। গুটিকয় অত্যাবশ্যক দিক আলোকপাত করা যাক।
আকাশ চিরকাল মেঘে ঢাকা থাকে না। মেঘ আর সূর্যের, আলো আর অন্ধকারের এবং হাসি আর কান্নার যুগলযাত্রা চিরদিনের নিত্যঘটনা। হার ও জিত তার ব্যতিক্রম নয়। সন্তানকে কেবল জিততে হবে—এ দীক্ষা না দিয়ে হারকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার ও ভবিষ্যতে আরও উদ্যমী হওয়ার শিক্ষা দিন। জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সন্তান হেরে গেলে বা ব্যর্থ হলে তিরস্কার না করে সন্তানের মনোবল চাঙা রাখতে আশার কথা বলুন। সান্ত্বনা দিয়ে পাশে থাকুন। সন্তানকে বোঝান পৃথিবীর সব মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই এক সঙ্গে জয়ী হতে পারে না। কেউ হারে বলেই কেউ জেতে। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সর্বাপেক্ষা ভালোভাবে যে চেষ্টা করে, তার পক্ষে জয়ী হওয়া সহজ হয়। শেখান, যে কখনোই হারেনি, সে কখনোই জেতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি। সন্তানেরা মা-বাবার কাছ থেকে এ বার্তা নিক যে ব্যর্থ হওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়, বরং নতুন করে আরও ভালোভাবে সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সূচনা করা। আঁধারের পর আলো আসে বলেই তা এত আকাঙ্ক্ষিত ও সুন্দর।
জীবন একটি দৌড় প্রতিযোগিতার মতো। সন্তানকে সবকিছুতেই প্রথম হতে হবে—এ ‘বিষবাক্য’ থেকে বের করে আনুন। একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক প্রতিযোগীই প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয় না। যদিও সবাই ফিনিশিং লাইন অবধি পৌঁছায়, তবু সবাই পদক পায় না। আর এ সত্য সবাই জেনেই দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। সবাই পদক পাবে না বলে মনোরথহারা হয়ে সবাই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে—এমন চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা ও শেষ পর্যন্ত দৌড়ে ফিনিশিং লাইন পর্যন্ত পৌঁছার মধ্যেই প্রতিযোগিতার আনন্দ ও সৌন্দর্য। জীবনকে দৌড় প্রতিযোগিতার মতো নিতে সন্তানকে শেখাতে হবে, যেখানে একসঙ্গে সবাই পদক পাবে না, কিন্তু সবাইকে শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে হবে। এ দৌড়ে কোনোভাবেই হেরে যাওয়ার ভয়ে হতাশ হয়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে না। মা-বাবাকেই সবার আগে সন্তানকে বলতে হবে, হেরে যাওয়া মানে হারিয়ে যাওয়ার সূচনা নয়; বরং সাফল্য অর্জনের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর শুভলগ্ন।
আমাদের অনেক মা-বাবাই সন্তানকে সরাসরি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটি বলতে চরম জড়তাবোধ করেন। ফলে, সন্তানেরাও মা-বাবাকে সরাসরি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মা বা বাবা’ কথাটি মুখফুটে বলতে অস্বস্তিবোধ করে; যদিও পরস্পরের প্রতি অতলান্ত ভালোবাসা রয়েছে। কেউ যদি প্রায়ই শোনে যে তাকে কেউ অনেক ভালোবাসে, তাহলে সে ভালোবাসার মানুষটির জন্য নিজে ভালো কিছু করার ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পায়; সুন্দর জীবন গড়তে সচেষ্ট হয়। সন্তানের হারজিত যা–ই হোক, সব সময় মা-বাবার ভালোবাসার হাতটি যেন সন্তানের কাঁধের ওপরেই থাকে; যেন ক্ষণিকের জন্যও সরে না যায়। সন্তানের প্রতিটি ভালো কাজের প্রশংসা করুন। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কার্পণ্য করবেন না। প্রয়োজনে সন্তানকে শাসন করবেন। তবে এর মধ্যেও যেন সন্তানের কাছে এ বার্তা স্পষ্ট থাকে যে আজ আপনার তাকে শাসন করতে হলো, কারণ আপনি তাকে ভালোবাসেন। ভালোবাসা পেলে সন্তান জীবনযুদ্ধে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেও খেই হারিয়ে ফেলবে না; আপনার ভালোবাসার চোখ থেকে সে যেন সরে না যায়, অন্তত এ জন্য হলেও সে বারবার উঠে দাঁড়াবে। সন্তানকে ভালোবাসুন। ভালোবাসা প্রকাশে সচেষ্ট হোন।
সব সময় আমার সন্তানকেই জিততে হবে, আমার সন্তানকে সর্বক্ষেত্রে প্রথম হতে হবে আর আমার সন্তানকেই সবার সেরা হতে হবে—এ ধরনের মানসিকতা থেকে মা-বাবাকে বের হয়ে এসে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পাঠ দিতে হবে। হারকে খেলাচ্ছলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা সন্তানকে মা-বাবাকেই দিতে হবে। মা-বাবাই পারেন কোথাও কোনো ক্ষেত্রে হেরে যাওয়া সন্তানকে জীবনযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে। মা-বাবা হোক সন্তানের জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ধ্রুব আশার আলোকবর্তিকা।
সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মা-বাবার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হলো সন্তানকে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করা। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, মা-বাবা সর্বস্ব নিঃশেষ করে সন্তানকে দেশে-বিদেশে পড়াশোনা করিয়ে, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করিয়ে, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে নিজেরা সন্তান কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে বৃদ্ধাশ্রম বা হাসপাতালের একাকী বিছানায় অশ্রুপাত করছেন। নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ কখনোই বিবেকবর্জিত কোনো কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নির্ভার থাকতে পারেন না। বিবেক তাঁদের হতাশা থেকে, মাদকাসক্ত থেকে, নোংরা কাজে জড়ানো থেকে এবং আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ থেকে বিরত রাখে। নিজেদের ও সন্তানের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের কথা ভেবেই সন্তানের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দান করা মা-বাবার অবশ্যকর্তব্য। যদি পারেন, তাহলে সন্তান হারিয়ে যাবে না; সন্তানকে আমৃত্যু আপনার পাশেই পাবেন।
দিন দিন গ্রাম শহরের রূপ নিচ্ছে। মানুষ এখন সর্বত্রই অশেষ কর্মব্যস্ত। নিজের ক্যারিয়ার আর স্বপ্নপূরণে ব্যস্ত মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে ভাবার ও সন্তানকে নিবিড়ভাবে সময় দেওয়ার সুযোগ খুব কমই পান। অথচ সন্তানের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যতের মজবুত ভিত রচনায় সন্তানকে মা-বাবার মানসম্পন্ন সময়দান অপরিহার্য। সন্তানকে মানসম্পন্ন সময় দিলে মা-বাবা যেমন সন্তানকে বুঝতে পারেন, তেমনি সন্তানও মা-বাবাকে বুঝতে পারে। পারস্পরিক বন্ধন তথা পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। পৃথিবীর সবকিছুই ফিরে ফিরে আসে। আজ আপনার সন্তানকে সময় দিন, আপনার সন্তান আপনাকে বার্ধক্যে বাড়িতেই সময় দেবে; বৃদ্ধাশ্রম বা হাসপাতালে ছেড়ে আসবে না। সন্তানকে সময় দিন, জীবনযুদ্ধে টিকে থেকে এগিয়ে যাওয়ার তালিম দিন।
পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা সন্তানকে শৈশব থেকেই দিন। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ সুন্দর করে চারপাশকে; সুন্দর করে সমাজ জীবনকে। সুন্দর ব্যবহার ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভ্যাস মানুষের রাগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় বিশেষ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। যে সহজে রাগে না, সে সহজে লক্ষ্য ফেলে ভাগে না।
সন্তানকে জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় তখনই, যখন প্রয়োগ নেই, চাহিদা নেই—এমন শিক্ষায় সময় ব্যয় হয়ে যায়। শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানকে মানসিক ও শারীরিকভাবে শক্ত করে গড়ে তুলুন। সন্তানকে চাকরিই করতে হবে—এমন মানসিকতা থেকে বের করে এনে যা আছে, তা দিয়েই কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত করুন। সর্বক্ষেত্রে ভালো করার লক্ষ্যে সন্তানকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করুন সব কাজে; প্রথম হতে নয়। সন্তানকে সন্তুষ্ট জীবনযাপনের শিক্ষা দিন। সন্তান তখন হারকে হার মনে করবে না, বরং নতুন করে শুরু করার সুযোগ মনে করবে। সন্তান হতাশায় হারিয়ে যাবে না।
আজকের ডিজিটালাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশনের এ কঠিন বিশ্ববাস্তবতায় আদর্শ ও সোনার টুকরো সন্তান পেতে হলে মা-বাবাকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। দায়িত্ব পালন না করে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সব সময় আমার সন্তানকেই জিততে হবে, আমার সন্তানকে সর্বক্ষেত্রে প্রথম হতে হবে আর আমার সন্তানকেই সবার সেরা হতে হবে—এ ধরনের মানসিকতা থেকে মা-বাবাকে বের হয়ে এসে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পাঠ দিতে হবে। হারকে খেলাচ্ছলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা সন্তানকে মা-বাবাকেই দিতে হবে। মা-বাবাই পারেন কোথাও কোনো ক্ষেত্রে হেরে যাওয়া সন্তানকে জীবনযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে। মা-বাবা হোক সন্তানের জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ধ্রুব আশার আলোকবর্তিকা।
মাহবুবুর রহমান উপ–কর কমিশনার পদে কর্মরত