পোশাকশিল্প

সংকট উত্তরণে কিছু প্রস্তাব

ক্রেতারা এ মুহূর্তে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেবেল দেখে শঙ্কিত হচ্ছেন। এনজিওকর্মীরা বিদেশে বড় বড় ব্র্যান্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন। আর আমরা এই প্রান্তে দেশি আর বিদেশিদের তিরস্কার শুনছি। ইইউ শুল্কমুক্ত-সুবিধা পরিহারের কথা ভাবছে, আমেরিকা জিএসপি তুলে নেবে বলে বারবার আমাদের সাবধান করছে। যত উত্তম সরবরাহকারী হই না কেন, বহু ক্রেতা তাদের সুনাম ক্ষুণ্নের আশঙ্কায় এ দেশ থেকে সরে পড়তে পারেন। এতে বাংলাদেশের ক্ষতির ঝুলি ভরবে বৈ কমবে না। আজকে প্রয়োজন একটি আমূল পরিবর্তনের কার্যকর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।

আমরা যে প্রস্তাবগুলো দিচ্ছি, তা সুধীসমাজ, গুণীজনেরা, ব্যবসায়ী মহল, আর সরকার বিবেচনা করতে পারে। এই শিল্পের জন্য কিছু করতে হলে শিল্প খাতকে ভালো করে বুঝতে হবে। শিল্পকে বন্ধ করা নয় বরং বন্ধ শিল্প নতুনভাবে শুরু করার মানসিকতা নিয়ে সব কাজ করতে হবে।

বিজিএমইএর কাছে চার হাজার ৩৮২টি কারখানার তালিকা রয়েছে, যার মধ্যে তিন হাজার ২৮০টি ঢাকায়, ৭৮৮টি চট্টগ্রামে, ৩১৪টি নারায়ণগঞ্জে। এই চার হাজার ৩৮২টির মধ্যে দুই হাজার ৬৮টি কারখানা সরাসরি রপ্তানি করে। বাকি দুই হাজার ৩১৪টি কারখানা, যার মধ্যে অনেক কারখানা পরোক্ষভাবে উৎপাদন করছে, বেশ কিছু বন্ধ ও অস্তিত্বহীন আছে। ৩৫ লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। বিকেএমইএর এক হাজার ৮৭০টি কারখানায় যেখানে ছয়-সাত লাখ শ্রমিক কাজ করেন, তার মধ্যে ৯০০টি প্রত্যক্ষভাবে রপ্তানি করে (যার আবার ৫০০টি প্রথম সারির আর বাকি ৪০০টি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারির), ২৭০টি সম্পূরক প্রতিষ্ঠান (অ্যাক্সেসরিজ) হিসেবে কাজ করছে। বাকি ৭০০টি কারখানা হয়তো বা বন্ধ, নতুবা অস্তিত্বহীন।

প্রকৃতপক্ষে, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অধীনে বহু কারখানা বহু বছরের খারাপ ব্যবসা ও অধিকাংশই রাজনৈতিক কোলাহলের কারণে রুগ্ণ অথবা বন্ধ হয়ে গেছে।

পোশাক রপ্তানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি, সার্বিক এবং চতুর্মুখী সমাধানের জন্য, প্রথম প্রয়োজন কারখানাগুলোর নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নিরীক্ষা, জরিপ ও পর্যবেক্ষণ। যেহেতু বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ভোটারদের সংগঠন, সেহেতু বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর পক্ষে নিরপেক্ষ নিরীক্ষণ সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বিজিএমইএ/ বিকেএমইএ নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তৃতীয় সংগঠনকে দিয়ে পরীক্ষণ প্রয়োজন। দেখা প্রয়োজন কটি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির কারখানা এবং কটি কারখানা বন্ধ। সময় বাঁচানোর জন্য এই যাচাই প্রক্রিয়াটি রাজউক এবং বিইউবিটির প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে কিছু ছাত্রছাত্রীকে দিয়েও করানো যেতে পারে।

এই তৃতীয় সারির কারখানাগুলোই অগ্নিবিষয়ক নিরাপত্তা এবং কাঠামোগত দুর্বলতায় ভোগে। প্রথম অবস্থায় এদেরই পরিচর্যা প্রয়োজন।

শিল্পের খাতিরে, এই শিল্প খাতকে বাঁচাতে হলে জরুরি প্রদক্ষেপ হিসেবে এই তৃতীয় সারির কারখানাগুলোকে স্থানান্তরিত করা প্রয়োজন। ঢাকা মেট্রোতে এক হাজার ৫৬৮টি কারখানার মধ্যে মাত্র ৬৪৭টি ইউডি নেয় এবং তাদের নিজেদের নামে রপ্তানি করে। বাকি আরও ৫০০টি দ্বিতীয়/তৃতীয় সারিতে ফেলা যেতে পারে। ঢাকা মেট্রো ও চট্ট মেট্রোতেই প্রথম থেকেই অপরিকল্পিতভাবে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এর সমাধান করতে হলে প্রয়োজন বোঝা—কী লাগবে, কত লাগবে। একটি শার্ট অথবা নিট গার্মেন্টস কারখানা তৈরির আনুমানিক ধারণা দিচ্ছি।

একজন শ্রমিকের জন্য ৫০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। ৫০০ শ্রমিকের একটি কারখানার জন্য লাগে ২৫ হাজার বর্গফুট। একটি নতুন কমপ্লায়েন্ট কারখানা তৈরির হিসাবের খতিয়ান নিচে দেওয়া হলো। ছয়টি তালায়, ছয়টি কারখানার জন্য তিন বিঘা জমি ১ দশমিক ৫০ কোটি; প্রতি কারখানা ২৫ লাখ, কনস্ট্রাকশন এক হাজার ৩০০ টাকা প্রতি বর্গফুট মোট ৩ দশমিক ২৫ কোটি, মেশিনারি ৩ দশমিক ৫০ কোটি, ফার্নিচার, ইলেকট্রো মেকানিক্যাল, অগ্নিনির্বাপণ ২ দশমিক ৮০ কোটি, মোট ৯ দশমিক ৮০ কোটি। এর অর্থ হলো ২৫ হাজার বর্গফুটের একটি কারখানার জন্য খরচ হয় আনুমানিক ১০ কোটি টাকা। একজন মালিক চাইলে একাধিক কারখানা তৈরির ব্যবস্থা নিতে পারেন।

তৃতীয় সারিতে যদি এক হাজার কারখানা থেকে থাকে, তবে মোট জায়গা লাগবে ৫০০ বিঘা। দুটি ভিন্ন স্থানে এ পল্লি গড়া সুবিধাজনক। প্রতি ছয়তলা ভবনে, ছয়টি কারখানার জন্য বরাদ্দ করতে হবে তিন বিঘা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশে সরকারের খাসজমি থেকে বরাদ্দ দিতে হবে এই পোশাকপল্লিকে। প্রথম ৭০০-কে সরিয়ে নিতে হবে। ক্রমান্বয়ে বাকি ৩০০টিকেও একইভাবে ঢাকা/চট্টগ্রামের কাছে একই পদ্ধতিতে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। শ্রমিকের সুবিধার জন্য ঢাকা/চট্টগ্রামের ৫০-৬০ কিলোমিটারের মধ্যে এ রকম জমি প্রয়োজন ও পাওয়া সম্ভব। গ্যাস, বিদ্যুতের ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে।

এই এক হাজার কারখানাকে সরাতে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার প্রয়োজন, যার প্রথমাংশের বরাদ্দ আনুমানিক তিন হাজার কোটি টাকা বর্তমান বাজেটে রাখার বিনীত প্রস্তাব রাখছি। (এর বেশ কিছু অংশে মালিকেরাও অর্থসংস্থান করতে পারেন) এই ছোট এক হাজার কারখানা নিজেরাই তাদের রপ্তানি আয় থেকে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, এই প্রক্রিয়া চলাকালে আরও বহু নতুন চাহিদা দেখা দিতে পারে। সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে তিন-চার বছরের মধ্যে এ কাজ সম্পাদন সম্ভব। এটিই হবে নিরাপদ শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।

এবার ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গে আসা যাক। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন, তা স্বীকার করছি। প্রথমেই বলি, ১ মে থেকেই মজুরি বৃদ্ধি করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। সময় দিয়ে বিক্রেতাদের ক্রেতার সঙ্গে আলোচনার সুযোগ দিয়ে, তারপর স্থির করতে হবে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের তারিখ। কারণ, ক্রেতারা আদৌ বেশি দামে কিনবেন কি না, আদৌ তাঁদের ভোক্তারা বর্ধিত দামে কিনতে রাজি হবেন কি না, তা বুঝতে হবে সবার আগে। অন্যথায়, ক্রেতাদের বিকল্প বাজারের দিকে ঠেলে দেওয়া যৌক্তিক হবে না। বিক্রেতাদের ধৈর্যসহ বোঝাতে হবে কেন আমরা সস্তা শ্রমের বিপক্ষে। আর একই সঙ্গে ন্যূনতম মজুরিকে শ্রমিকের উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সংযোগ করতেই হবে। তাতে শ্রমিকের উৎপাদন দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যাবে।

অন্যদিকে, কারখানার দালান পরীক্ষা ও অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু বড় ব্যান্ড একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যাতে তারা তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নিয়ে একজন নিরপেক্ষ চেয়ার নিয়োগ করে দুই পাশে তিনজন কারখানামালিক ও তিনজন শ্রমিকনেতার সমন্বয়ে একটি ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠন করছে। এই চুক্তি অনুযায়ী তারা ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোকে পাঁচ বছরে ২৫ লাখ ডলার দেবে। কিন্তু দেশের সার্বিক প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ করা টাকার পরিমাণ অত্যল্প। এই ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিজেদের সরবরাহকারী কারখানাগুলোর জন্য এই বিশেষ পদক্ষেপগুলো নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আশা করি, আরও ক্রেতা সংগঠন এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। একটি ছোট/মাঝারি আকারের কারখানাকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় শক্তিশালী করতে হলে লাগে নয় লাখ ৩৬ হাজার টাকা, যার প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয় হবে যন্ত্রপাতি কিনতে আর প্রশিক্ষণে। পাশাপাশি দুই লাখ খরচ হবে কেবল পিএ (পাবলিক অ্যাড্রেস) সিস্টেম কিনতে। কাজেই যদি এই কারখানাগুলোকে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে, অর্থ সহায়তা দিয়ে, তৃতীয় সারি থেকে প্রথম/দ্বিতীয় সারিতে নেওয়া যায়, তাহলে স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে এ পদক্ষেপটি অত্যন্ত ফলপ্রদ হবে বলে আশা করি।

একই সঙ্গে শ্রমিককল্যাণ ট্রাস্টের কথাও ইতিমধ্যে উঠেছে। এই ট্রাস্টটিকে শিগগিরই কার্যকর করতে হলে, ক্রেতা এফওবি মূল্যের শতকরা ১ ভাগ আর সরবরাহকারী কারখানা মূল্য সংযোজনের শতকরা ১ ভাগ দিয়ে যৌথ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে পারে। এটি শ্রমিকের শতকরা ৫ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার বিকল্প ও স্বচ্ছতর পদ্ধতি হিসেবে গঠন করা যেতে পারে। তবে বিতরণে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে।

এসব কিছু করতে হলে বিজিএমইএ ক্রেতা, কারখানা, সরকার, এনজিও, শ্রমিকনেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিল্পের খাতিরে, এই ৪০ লাখ শ্রমিকের কথা ভেবে, কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থান নেওয়া হবে স্বার্থপরতার শামিল।

রুবানা হক: ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মোহাম্মদী গ্রুপ।

আনিসুল হক: সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, সার্ক চেম্বার।