প্রতিক্রিয়া

সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

আাঁাকা: তুলি
আাঁাকা: তুলি

৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনের ‘সংকট উত্তরণে একটি গুচ্ছ প্রস্তাব’ দেখে কিছুটা আশান্বিত বোধ করছি। তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে এটা উল্লেখ করেছেন, ‘...দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে, এমনটি বলা যায় না। এ জন্য সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্থায়ী সমাধান সূত্র উদ্ভাবিত ও বাস্তবায়িত না হলে দেশে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে না।’
নূহ-উল-আলম লেনিনের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। উপক্রমণিকায় তাঁর বক্তব্য: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদীয় নির্বাচন নিয়ে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। তবে তাঁর প্রদত্ত দুটি শর্ত পূরণ হলে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। প্রথম শর্ত, ‘সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে হবে।’
সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তো বিএনপি জোরালোভাবে রয়েছেই। এ সম্পর্কে খালেদা জিয়া সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তা পরিহারের পথ বাতলিয়েছেন। ন্যায়সংগতভাবে বিচার মারফত যুদ্ধাপরাধীর শাস্তির পক্ষে তিনি রয়েছেন এবং বিএনপিও। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর দিয়েছেন। জামায়াত এককালে আওয়ামী লীগের সক্রিয় সহযোগী ছিল। নির্বাচনকালীন কার সমর্থন কে নেবে, তা কি বলে-কয়ে করতে হবে?
আর শুধু জামায়াতে ইসলামী কেন? তালেবানরা রয়েছে। হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদি দলও আছে। ‘বঙ্গরাজ্য’ দলও আছে। তাদেরও তো বিরোধিতা করতে হবে। তা ছাড়া আইনগতভাবে কোনো দল যদি নিষিদ্ধ বা অনিবন্ধিত হয়, তাহলে তার সঙ্গে কারও জোট বাধার তো প্রশ্ন ওঠে না। সব দলকেই আইন মানতে হবে।
সুতরাং বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এটা কোনো শর্তই নয়। আইন অনুযায়ী সব দলই তাদের সমর্থক বা সহযোগীদের বেছে নিতে পারে। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, ‘হত্যা, সন্ত্রাস, অবরোধ, হরতাল, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও হানাহানি বন্ধ করতে হবে।’ আরে, এটা তো খালেদা জিয়া ও বিএনপিরও দাবি। খালেদা জিয়া তো সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে মাত্র এক মাসের মধ্যে সরকারি দলের উদ্যোগে তিন শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনার ফিরিস্তি দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও হানাহানির ব্যাপারে মুখ্যতর তো সরকারি দলকেই দায়ী করা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরাও এসব কথা বলেছেন। বিএনপির সব গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড তো প্রায় নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। হাজারো নেতা-কর্মী জেলে। নির্যাতিত। চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ ও মিছিলের ওপর থেকে সব বিধিনিষেধ তুলে দিতে হবে।’ এসবে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তো হরতাল-অবরোধের প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপি তো শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনই করতে চায়। বাস্তবিকই সরকার নিপীড়ন ও হয়রানিমূলক আচরণ ত্যাগ করলে তো বিএনপি হরতাল-অবরোধের পথে যায়নি; যাবেও না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই শর্তও প্রতিবন্ধক নয়, কেননা দুই পক্ষের এ ব্যাপারে মতৈক্য থাকলে সাংঘর্ষিক অবস্থার তো সৃষ্টি হবে না, বরং আস্থার পরিবেশ ও আবহ তৈরির জন্য এ-জাতীয় দ্বিপক্ষীয় আচরণেরই প্রয়োজন।
লেনিন সংসদকে কার্যকর করার জন্য, জাতীয় উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে এবং জাতীয় স্বার্থে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা মারফত মতৈক্য প্রতিষ্ঠার যে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন, তা আমি সমর্থন করি।
লেনিন প্রথমেই বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অনুষঙ্গ আর্থসামাজিক সংকটের কথা স্বীকার করে স্থায়ী সমাধানের জন্য সাতটি সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। সদিচ্ছা থাকলে এ প্রস্তাবগুলো সুবিবেচনা করে মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভবপর হতে পারে।
তাঁর প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, ‘বর্তমান সংবিধানের আওতার মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।’ খালেদা জিয়াও সংবাদ সম্মেলনে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই’ বলে উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে, পুরোপুরি একই কথা। লেনিন বলেছেন, এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বর্তমান সংবিধানের আওতায়ই উপায় উদ্ভাবন সম্ভব হবে। উদ্দেশ্য অভিন্ন থাকলে এ বিষয়ে সংলাপ বা আলোচনা নিশ্চয়ই ফলপ্রসূ হতে পারে। বিগত নির্বাচনের আগে আমরা এ বিষয়ে কয়েকটি ‘ফর্মুলা’ বা ‘উপায়’-এর কথা শুনেছি। আমার মনে হয়, উদ্দেশ্য ঠিক রেখে এ বিষয়ে আলোচনা মারফত কোনো গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন দুষ্কর হবে না।
দ্বিতীয় প্রস্তাব হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণ। এ ব্যাপারে তো সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশনই বিবেচনা করছে বলে জানি। সুতরাং এখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে?
তৃতীয়, ধর্মের রাজনীতি ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ। আমার জানামতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো দলেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
চতুর্থ, কোনো রাজনৈতিক দল সংসদ বর্জন করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালীন প্রথমেই এবং পরবর্তী সময়ে উভয় দলই এটা করেছে এবং এর পরিণতি অনুধাবন করেছে। আমার মনে হয়, আলোচনা মারফত এ সম্পর্কে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
পঞ্চম প্রস্তাব তো বিএনপিরও দাবি। সুনির্দিষ্ট গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতি তথা সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন, হয়রানি, মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীনতা ও গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
ষষ্ঠ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ ও আইনসংগত সভা, সমাবেশ, মিছিল, পদযাত্রা, অনশন ইত্যাদির ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা চলবে না। তার নিশ্চয়তা বিধান করা যেতে পারলে হরতাল-অবরোধের তো প্রশ্ন ওঠে না।
সপ্তম প্রস্তাব অনুসারে বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া অথবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা চলবে না এবং কোনো ধরনের বিচারের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না। দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বিএনপি অবশ্যই এ প্রস্তাব সমর্থন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
উপসংহারে লেনিন সুশীল সমাজের দায়িত্ব এবং বাংলাদেশের ইমেজ, সহিষ্ণু অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ ও দারিদ্র্য অপসারণ সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে কোনো দলেরই দ্বিমতের অবকাশ নেই।
বিবেচনাযোগ্য প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করায় আমি লেনিনকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে, সমঝোতা স্থাপনের জন্য প্রস্তাবিত সংলাপের শুরু কবে হবে? খালেদা জিয়া তো এ ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ও সমর্থনের কথা জানিয়েছেন এবং অতি দ্রুত সমাধানের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছেন।
নূহ-উল-আলম লেনিন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন দায়িত্বশীল সদস্য। তিনি যদি তাঁর দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংলাপের জন্য যথোপযুক্ত পর্যায়ে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন, জাতির ভাগ্যাকাশে ঘনায়মান দুর্যোগের ঘনঘটা অপসারণের উদ্যোগের সূচনা তাহলে হতে পারে।
অবশ্য আমি বিনয়াবনত চিত্তে আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে বর্তমান পরিস্থিতিতে আত্মসন্তুষ্টির বা ক্ষমতার দর্পধারী হওয়ার অবকাশ নেই। তাঁরা যেন এই কল্পলোকের কাচের দেয়ালঘেরা স্বর্গরাজ্যে বাস না করেন যে জনগণ তাঁদের ‘নির্বাচিত’ করে সংসদে পাঠিয়ে সরকার গঠনের দায়িত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের কথামতো একটি ‘সাংবিধানিক আবশ্যকতা’ পূরণ করার জন্য ছিল এই নির্বাচনের আয়োজন। এখন প্রয়োজন অবিলম্বে সত্যিকারের একটি নির্বাচনের আয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা এই তথাকথিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে কোনো ‘টিম’ পাঠায়নি, যাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে তারা মতামত দিতে পারে। কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট তো দুই-তিন দিন আগে নতুন করে অনুরোধ জানিয়েছে অবিলম্বে নিরপেক্ষ পরিচালনায় একটি সুষ্ঠু, সব দলের অংশগ্রহণ সমন্বিত, গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, (এবং অন্যান্য দেশ ও সংস্থারও একই মতামত) তাদের এ ব্যাপারে পূর্বঘোষিত নীতির পরিবর্তন নেই। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে, ৫ জানুয়ারির পর একটি সরকার বাংলাদেশে সমাসীন হলেও গণতন্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে তা হয়নি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য একটি সাধারণ নির্বাচন অপরিহার্য। সরকারি দলের পক্ষে ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’—মনোভাব হবে আত্মঘাতী।
বর্তমানে বিরোধী দলগুলো এবং গণতন্ত্রকামী জনগণের যে আপাত-নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে তা হলো একটি আশামিশ্রিত অপেক্ষা বা প্রতীক্ষার ক্ষণ। বিএনপি দল গোছাচ্ছে আর আওয়ামী লীগও নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় ও সুযোগ পাচ্ছে। নতুন নতুন ‘কেস’ দিয়ে বিএনপির নেতারা বা তাঁদের পরিবারকে নিগৃহীত করার চেষ্টা করলে বা নিপীড়নমূলক আচরণ বা মন্দভাষণ করলে কিন্তু ফলপ্রসূ আলোচনা, সংলাপ বা সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। সরকারের প্রচেষ্টা হতে হবে আন্তরিক। এবং তাতে বিরোধী দলের সহযোগিতাও হবে ঐকান্তিক।
বাংলাদেশের জনগণ সত্যিকারের গণতন্ত্র ও সুশাসনের যথার্থ দাবিদার। এর প্রতিষ্ঠায় তাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রাম অতুলনীয়। এই ক্রান্তিকালে ক্ষমতাধর নেতারাই নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেন যে বাংলাদেশ পথ হারাবে না।

ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।