প্রকৃতি

শীতের স্নিগ্ধতায় কিছু বৈরিতা

কুয়াশা মোড়ানো ভোরে দূরগামী পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে বুকের ভেতর ভাঙনের শব্দ পাই। ওরা এই জঞ্জালের নগর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেই কবেই। তাহলে কী আর করা, এই মোহনীয় অতিথিদের দেখার জন্য খানিকটা দূরেই যেতে হবে এখন। যাচ্ছেন অনেকেই। দেশের বিল-হাওর আর উপকূলজুড়ে ওদের আস্তানাগুলো ছড়িয়ে আছে। তবে শুধু অতিথি পাখির জন্যই নয়, বিচিত্র কারণেই শীত আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত।
তাই শীতের পরিযায়ী মন নিরন্তর ছুটে চলে। এই নিরন্তর ছুটে চলার পথে আনন্দ জুগিয়ে যায় বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা সরষের মাঠ; ডাল-কাউন-সরিষা, শীতের অতিথি ফুল, খালপাড়ে তুলে রাখা ভেসাল, লাউয়ের মাচা, তাল-সুপারির বন। এত কিছু দেখেও যেন অতৃপ্ত মন। ফের রামুর নির্জন পাহাড়ি পথ। দুই পাশে দুর্মর সবুজ। থেকে থেকে একহারা গড়নের গর্জন বন। হঠাৎ দু-একটি প্রাকৃতিক লেক। ভালোভাবে কান পাতলে শুধু পাখির কূজন। তবু মনে হয়, কাছেপিঠে কেউ যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলে। হয়তো গাছেরাই কথা বলে নিজেদের সঙ্গে। নির্জনতার এই আখড়াটুকু একসময় হয়তো আর থাকবে না।
হেমন্তের সোনালি মাঠগুলো কৃষকের মুখে হাসি ফোটালে অতঃপর কিছুদিন বিরান পড়ে থাকে সেই শস্যভূমি। বিবর্ণ স্তূপীকৃত ঝরাপাতা মমতার বন্ধনে জড়াতে না-জড়াতেই চারপাশে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। তখন ক্রমেই মমতার বন্ধন শিথিল হতে থাকে। উদোম বন-প্রান্তরে কেবল শীতার্ত বাতাস ঘুরপাক খায়। ধুলোবালির সঙ্গী হয়ে উড়ে যায় ঝরাপাতার ছাই, উচ্ছিষ্ট। চারপাশে ঝুলে থাকে সোঁদা গন্ধ। দূরের ফসলের মাঠ থেকে আসে নাড়া পোড়ানো তীব্র ধোঁয়াটে ঘ্রাণ। দুরন্ত শিশুরা ঢিল ছুড়ে নীড়ের পাখিদের আবাসন-সংকট তৈরি করলে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। অনেক দিন হলো—সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে এখন আর ডাহুকের তীক্ষ আর্তনাদ শুনতে পাই না।
ফেলে-আসা সেই বাঁশঝাড়গুলো কেমন আছে? এখনো হলুদ বাঁশপাতারা হিমবাতাসে উড়ে বেড়ায়? তাদের ঘিরে বকপাখিদের কোলাহল সন্ধ্যা মাতায়? পুঁটিমাছের আশায় ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কানি বক? কাদাখোঁচা আর টি-টি পাখিরা ঢোলকলমির ঝোপে লুকিয়ে থাকে?
চারদেয়ালের বন্দিজীবনে এখন আর এসব ছুঁয়ে দেখার সুযোগ নেই। বাংলার জনপদে ছড়িয়ে থাকা শীতের বর্ণিল শস্যভূমি শুধু মনেরই নয়, চোখের খোরাকও জোগায়। আছে ডাল, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, গম, ভুট্টা। আরও কত কী! দিগন্তজোড়া সরষেখেতে শুধুই কনক রঙের ছড়াছড়ি। সে রং মিশে যেতে থাকে বিকেলের মায়াবী আলোয়। শীতের বিষণ্ন বিকেলটাও বড্ড সংক্ষিপ্ত। দুপুর গড়িয়ে কখন যে চট করে বিকেল নামে, বোঝা যায় না। দিনের আলোকে শীত ও সন্ধ্যার অন্ধকার গ্রাস করার আগে পথিক পৌঁছে যেতে চায় গন্তব্যে। তখন অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগেই কুয়াশার হালকা আবরণে ঢেকে যায় চারপাশ। দূরে সুপারির বনে যখন সূর্যটা হেলে পড়ে, গৃহস্থের রসুইঘরের ধোঁয়া আর কুয়াশা মিলে তখন এক মায়াবী মেখলা পরিয়ে দেয় গোটা গ্রামকে। সায়াহ্নের এই আলো-আঁধারির খেলায় তখন ক্ষয়ে যাওয়া পাণ্ডুর চাঁদ আবছা আলো ছড়াতে থাকে। এ আলো আরেক অপার রহস্য ছড়িয়ে দেয় বনে বনে, মাঠে মাঠে, গ্রামে গ্রামে।
মূলত হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই প্রকৃতিতে শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রকৃতির মতো মানুষের মনও বদলাতে থাকে। শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতির সবুজ প্রলেপ খসে পড়লেও আমাদের কল্পনায়, কবির ভাবনায় তার আবেদন ভিন্ন রকম। নজরুলের কবিতায় পাওয়া যায় পৌষের আবাহন গীত। তাতে থাকে বিগত ঋতুর বিদায়-প্রসঙ্গ, ঝরাপাতাদের বেদনাসিক্ত বিলাপ। শীতের ভালো লাগাটা কবিগুরুর মনে দাগ কাটতে না পারলেও বিরহের সুর গেঁথেছেন ‘উদেবাধন’ কবিতায়। তাতে গাছের শুষ্ক শাখা, জীর্ণ পাতা, কুয়াশার ঘন জাল, হিম হিম ভাব—কোনোটাই বাদ যায়নি। শীতের আগমনকে তিনি বসন্তের জয় হিসেবেই দেখেছেন। পৌষালি দিনে প্রকৃতিতে চলে এক অদ্ভুত কুয়াশার খেলা। কুয়াশার রহস্যময় আবরণ মানুষের দৃষ্টিসীমা বেঁধে দেয়। রাতের কুয়াশা ভোরের শিশির হয়ে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। ঝরা পালকের কবি জীবনানন্দের কবিতায় কুয়াশার মাঠে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা পরাবাস্তব সংলাপে অনবদ্য হয়ে ধরা দেয়।
কিন্তু আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত মিষ্টি-মধুর এই ঋতুটি যেন ক্রমেই তার আপন সত্তা হারিয়ে ফেলছে। বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির রূপ-সুধা প্রাণভরে উপভোগ করার মতো অনুকূল পরিবেশও নেই যেন। আমাদের সেই মায়াবী গ্রামগুলো এখন ক্রমেই নিষপ্রাণ শহরে পরিণত হচ্ছে। বাড়তি মানুষের চাপে শহরের আদলে বাড়ি ঘেঁষেই তৈরি হচ্ছে অনেক বাড়ি। পথে পথে ব্যস্ততা, মোটরের বিরক্তিকর শব্দ, কর্কশ হর্ন। যত্রতত্র মানুষের পদচারণ, হই-হুল্লোড়, ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবি, আতঙ্ক, ভয়। এসবের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির নিখাদ আনন্দলোকে পৌঁছা অনেকটাই দুঃসাধ্য। সবচেয়ে বড় দুর্যোগ চারপাশের বিষাক্ততা। প্রাকৃতিক সারের পরিবর্তে যত্রতত্র রাসায়নিক সারের ব্যবহার, উচ্চফলনশীলের নামে মাটির উর্বরতা শক্তি কমানোর মতো ক্ষতিকর কাজ আমাদের সোনালি সম্ভাবনার এসব শস্যভূমিকে রীতিমতো হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক বিষাক্ত উপাদান ফরমালিন। তাহলে আমাদের নির্ভেজাল বাতাসের নিশ্চয়তা কোথায়?
জানি, জীবন-জীবিকার প্রাণান্ত দৌড়ে আমাদের একান্ত সময়গুলো বিক্রি হয়ে গেছে। কেউ আর হারিয়ে ফেলা সেই নির্জন খালপাড়, বাড়ির পেছনের ধু ধু মাঠ, মধ্য দুপুরে শালিকের গান, বিষণ্ন বিকেলের মাঠপার, শিশিরভেজা শিমফুল-লাউয়ের ডগা—এসব আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কারণ, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ ফেলে আসা জীবনের এসব টুকরো স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকেন। তাঁর কাছে রাইন নদী নয়, পদ্মাই প্রিয়। নায়াগ্রা নয়, মাধবকুণ্ডই খাঁটি।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
tarupallab@gmail.com