ঋতুবন্দনা

শীতের তিন মিঠা

শীতের সহভাগী
শীতের সহভাগী

আকাশের হিম গলে গলে নামতেই দেশের শহর গ্রাম ভেসে যায় পৌষের ঘন কুয়াশায়। সেই কুয়াশায় মাঠ খায়, আকাশ খায়, নিঃশব্দে গিলে খায় নদীর ফেরিঘাট। বিশাল বাঁশঝাড় গ্রাস করেও খিদে মেটে না দানবটার। সঙ্গে কনকনে উত্তুরে বাতাস থেকে থেকে যেন শিং মাছের বিষমাখা কাঁটা বিঁধিয়ে দেয় শরীরে। বেলা বাড়লে পিছু হটে কুয়াশা; একে একে মাঠ নদী আকাশ সব উগরে দেয় জঠর থেকে। একটু পরে কুয়াশার চাদর সরিয়ে আকাশে উঁকি দেয় ম্লান-মনমরা ভোরের সূর্য।
‘পান-পানি-পিঠে: শীতে তিন মিঠে’—কথাটা নির্ভেজাল সত্য। তাই বলে শীত শুধু বিলাসব্যসন আর উৎসবেরই ঋতু নয়, আমাদের শীত পশ্চিমা রোমান্টিকতার আদলে কেবলই বসন্তের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকে না। এই ঋতু শ্রমের ঋতু, কর্মের ঋতু—কর্মসংস্থানের ঋতু। কে না জানেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি সবচেয়ে বেগবান হয় এ সময়েই। চিরাচরিত কৃষি ভিত্তিতে জীবিকায়নের গণ্ডির বাইরে বেকার যুবকদের নানা অপ্রচলিত পেশার পথ খুলে দেয় শীতকাল।
সমুদ্রসৈকত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে শীতের দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন জীবিকার উন্মেষ ঘটেছে এই ঋতুটির দাক্ষিণ্যে। যাঁরা এসব পেশায় যুক্ত, তাঁদের অনেকের সংসারের চাকা বছরভর সচল রাখে শীতের কয় মাসের উপার্জন। অথচ এবার দেশজুড়ে সহিংসতায় শীতের শুরু থেকেই পর্যটনকেন্দ্রগুলো শূন্য—খাঁ খাঁ। স্পিডবোটগুলো সাগরে ভাসার বদলে বেলাভূমির বালুতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অন্যান্য যানবাহনও ঝিমায় যাত্রীর অভাবে।
বাংলাদেশের গোটা উপকূলজুড়ে এখন মাছ ধরার মৌসুম। ঝড়বাদলা না থাকায় সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এখন শান্ত। তাই বহু মাঝি, জেলে আর নৌকার মহাজন মাছ ধরতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সাগরে কাটান। তাঁদের কষ্ট, পরিশ্রম আর নিঃসঙ্গতার পুরস্কার দিতে সাগরও কার্পণ্য করে না। নানা জাতের মাছে তাঁদের নৌকার খোল ভরে ওঠে; সেই মাছের কেনাবেচায় গমগম করে উপকূলের দ্বীপ। শত শত মানুষের আনাগোনায় সমুদ্রের কূলে যেন হাট বসেছে। বিভিন্ন শহরে, বন্দরে, আড়তে এখানকার মাছ চালান যায়; বালুর চরায় মাছের একটা বড় অংশ রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় শুঁটকি। দেশের চাহিদা মিটিয়েও এই শুঁটকি রপ্তানি হয় বিদেশে। এখানে শীতের তিন মাস অস্থায়ী দরমার ঘর বেঁধে ব্যবসা করেন নানা জায়গা থেকে জমায়েত হওয়া মাছ ব্যবসায়ীরা।
শীতে ঠান্ডা যত কড়া হয়, তত বেশি রস নামে খেজুরগাছে। সেই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের গুড়—পাটালি, নলেন, বালি, লালি আর মেলা গুড়—কত নাম গুড়ের। ‘জিরান কাটের’ রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পাটালি গুড় স্বাদে-গন্ধে অদ্বিতীয়, তা সমঝদারমাত্রই জানেন। শীতজুড়ে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়, বিশেষ করে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনায় খেজুরগাছ চাঁছা হয় রসের জন্য। মোরগ ডাকা ভোরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে খেজুরগাছ বেয়ে রস নামায় ‘গাছি’। রসভরা কলসগুলো বাঁকে বেঁধে সকালেই গাছি পৌঁছে যায় রস জ্বাল দেওয়ার ‘বাইনে’। গুড় তৈরির পর কলসি ভরে মহাজনের ঘরে দিয়ে আসতে হবে। সারা বছর এ গুড় খাওয়া ও বিক্রি হয়।
রসের পর শীতের আরেক উপহার সরষে ফুলের মধু। পেশাদার মধু সংগ্রহকারীরা হলুদ ফুলে ভরা বিস্তীর্ণ সরষেখেতের পাশে সারি সারি পোষা মৌমাছির বাক্স পেতে রাখে। কয়েক দিন পর পর সেই বাক্সের মধু তোলা হয়। এই ভ্রাম্যমাণ মধু সংগ্রহকারীরা এক জায়গায় ফুল ঝরে গেলে অন্য জায়গায় হাজির হন। সবে সরষে ফুল ধরেছে এমন খেতে বাক্স পেতে অস্থায়ী ডেরা বাঁধেন। খেতের মালিকও আপত্তি করেন না, বরং খুশিই হন। কারণ, মৌমাছি তাঁর খেতে পরাগায়নে সাহায্য করে সরষের ফলন বাড়াবে।
সেকালে শীতের ঢাকার আকাশে উৎসবের মেজাজে ভেসে বেড়াত শত শত রংবেরঙের ঘুড়ি। ১২৮৭-এর অগ্রহায়ণের বঙ্গদর্শন বলছে, ‘শীতকালে ঢাকায় প্রত্যেক দিন পাঁচ শ/ সাত শ ঘুড়ি উড়ে। সরস্বতী পূজার দিন শহরের উত্তরের মাঠে (সম্ভবত রেসকোর্সের মাঠ) যে কত ঘুড়ি উড়িয়া থাকে তাহার সংখ্যা বলা যায়নি। ঘুড়ি কাটিয়া গেলে তাহা ধরিবার জন্য শত শত লোক বাঁশ হাতে দৌড়িয়ে থাকে। ইহা দেখিয়ে বড় চমৎকার।’ এখনো ঢাকায় কিছু ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়; ঘুড়ি উৎসবও হয়।
আমাদের চোখের সামনে দেখতে দেখতে শীতের ঢাকার চেনা অনুষঙ্গগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সত্তরের দশকের শেষের দিকেও বনানী-গুলশানে জোনাকি জ্বলত ঝোপে-ঝাড়ে। কবরস্থানের পাশের ফাঁকা জায়গায় শিয়াল ডাকত রাতে দু-তিনবার; একটি-দুটি নয়, একাধিক এবং সম্মিলিত কণ্ঠে। তখনো দু-চারটি শিমুলগাছকে দেখা গেছে লাল ফুল ফুটিয়ে অহংকারী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। গাছপালা বেশি থাকায় শীতের দুপুরে দু-চারটি অলস বকের ওড়াউড়ি চোখে পড়েছে বিনা প্রয়াসে। কামাল আতাতুর্কের পাশের একদা ফাঁকা প্রান্তটি এখন ঐতিহাসিকের গবেষণার বিষয়।
সেদিনের ফাঁকা কুয়াশাঘেরা মাঠে এখন হাট-বাজার, সুপার মার্কেট, আর আকাশ আছড়ানো ভবনের ভিড়। তাদের কারও কারও মাথায় উঁচু উঁচু সেলফোনের টাওয়ার। শুনেছি, ঘনবসতি আবাসিক এলাকায় এ ধরনের উচ্চক্ষমতাবিশিষ্ট তরঙ্গের বিকিরণ মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। জানি, প্রযুক্তিকে পিছু হটানো যায় না, কিন্তু তাকে নির্বিচারে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, অথচ রাজধানীর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করার কথা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত।