‘সেই শিশু শ্রমিকের কথা তুমি বলো, যে তার/ দেহের চেয়ে বেশি ওজনের মোট বয়ে নিয়ে যায়,/ ব্রাশ করে জুতো, চালায় হাঁপর, আর বর্ণমালাগুলো/ শেখার আগেই যে শেখে ফিল্মের গান,/ বিড়ি টানে বেধড়ক। তারপর একদিন ফুটো ফুসফুসে/ ঝরিয়ে রক্তের কণা টানে যবনিকা জীবনের।/ তুমি সেই শিশুশ্রমিকের বেদনার কথা বলো।’
‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস ২০২১ ’-এ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা মনে পড়ে গেল। এ বছর শিশুশ্রমের ওপর সংকটের প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বে শিশুশ্রমে আনুমানিক ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু রয়েছে, যার মধ্যে ৭ কোটি ২০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। গত বছর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের ‘চাইল্ড লেবার: এ টাইম অব ক্রাইসিস, এ টাইম অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারি অনেক শিশুকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে, যা বিগত ২০ বছরের অগ্রগতির পরে প্রথমবারের মতো শিশুশ্রম বাড়িয়ে দিতে পারে।
কোভিড-১৯-এর কারণে জীবিকা হারিয়ে দরিদ্র হয়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষতি মোকাবিলা করে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে পরিবারগুলো শিশুশ্রমের আশ্রয় নিতে পারে। শিশুরা যদি বিদ্যালয়ে না যায়, তাহলে এ আশঙ্কা আরও বেশি। প্রতিবন্ধী, শরণার্থী, পথে বসবাসকারী শিশু, দুর্যোগকবলিত এলাকার শিশুসহ বেশ কিছু ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশু অতিরিক্ত ঝুঁকিতে আছে। শিশুশ্রমের পাশাপাশি কন্যাশিশুরা ঘরের কাজে অতিরিক্ত সময় দেবে এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নকারীর ভূমিকা নিতে বাধ্য হবে। অনেকে হয়তো আর কখনো বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে পারবে না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৭ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। কৃষি, নির্মাণ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, সড়ক–পরিবহনসহ নানা ক্ষেত্রে শিশুরা কাজ করছে। আমরা প্রতিদিন বাস, টেম্পো, খাবারের দোকান এবং পথে ফুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করা শিশুশ্রমিকদের দেখতে পাই।
গবেষণা থেকে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্যের ১ শতাংশ বৃদ্ধি শিশুশ্রমে কমপক্ষে ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটায়। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ মহামারির কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর ফলে শিশুশ্রমের ওপর কী প্রভাব পড়ল, তার হিসাব কেউ রাখছে কি? এক বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম কতটা বেড়ে গেল, তা কি আমরা জানি?
দেশের জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী, কাজে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর। তবে ১২ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা হালকা শ্রমে নিয়োজিত হতে পারবে, যদি তাদের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত না হয়। হালকা শ্রমের সংজ্ঞা ও কাজে যোগদানের শর্তগুলো নির্দিষ্ট করা হয়নি। সরকার ৩৮টি খাতকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে, ১৮ বছরের নিচে কাউকে এসব কাজে যুক্ত করা যাবে না। কিন্তু এটি মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশের ঝালাই (ওয়েল্ডিং), সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে ২০১০ সালে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে নতুন করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে তা খরচ করতে হবে। অন্যথায় একের পর এক কর্মপরিকল্পনা করা হলেও শিশুশ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, চরম দারিদ্র্য থাকলেও একটি এলাকায় শিশুশ্রমের অবসান ঘটানো সম্ভব, যদি সেখানকার মানুষের কাছে শিশুশ্রম আর গ্রহণযোগ্যতা না পায়। বাংলাদেশে শিশুশ্রম বেশ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া হয়।
কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে শিশুদের সরিয়ে আনা সম্ভব। যেমন পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে শিশুদের অংশগ্রহণ, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করার কুফল সম্পর্কে মা-বাবা ও নিয়োগদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। শিশুরা যদি নিরাপদ কোনো কাজে নিয়োজিত থাকে, তবে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জীবনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সহায়তা করা উচিত, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে যথোপযুক্ত কাজ পেতে পারে।
শিশুশ্রমবিষয়ক সব নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)-এ ‘হালকা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা এবং আইন লঙ্ঘনের শাস্তি সুস্পষ্ট করা দরকার। গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার সঙ্গে মা-বাবা এবং অভিভাবকদের শিশুশ্রমের নেতিবাচক দিক বোঝানো প্রয়োজন। গৃহকর্মসহ সব খাতে শিশুদের নিয়োজিত করার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা জরুরি। শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় যে বিষয়গুলোতে জোর দিলে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা যাবে তা হলো সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা এবং শিশুদের নিরাপদে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
শিশু শ্রমিকদের বেদনার কথা বলা যথেষ্ট নয়; শিশুশ্রম নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সমাজের সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী