মতামত

শিশুদের হাতে শিশু খুন কিসের ইঙ্গিত

‘বন্ধুকে খুন করে তারই জানাজা-দাফনে অংশ নিল কিশোর’। এই শিরোনামটি ২০২০ সালের ৭ আগস্ট প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। খুনের কারণ অতি তুচ্ছ। সামান্য কথা-কাটাকাটি মাত্র। একই বছর ১৩ বছর বয়সী এক শিশু ৪ বছরের এক প্রতিবেশী শিশুকে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দী করে একটি পরিত্যক্ত ঘরে ফেলে রাখে। চলতি বছর জানুয়ারির ৮ তারিখে সিফাত নামের ১২ বছর বয়সী শিশুকে হত্যা করে তারই ছয় বন্ধু। তাদের দুজনের প্রত্যেকের বয়স মাত্র ১০ বছর। অন্য চারজনের বয়স ১২ বছর। খুন হওয়া শিশুটির একমাত্র অপরাধ সে ছয়জনের একজনের পায়ে নিজ পায়ের চাপ দিয়ে ফেলেছিল। গত মাসেই ফেনীর কালিদহে শিশু তিশাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী তিশারই আপন চাচাতো ভাই। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া সেই চাচাতো ভাই পূর্ব আক্রোশের জের ধরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানি যে, কামরাঙ্গীরচরে দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের বয়স ৯ বছরের কম ছিল। ২০১৬ সালের শেষ দিকে আরেকটি শিশুকে খুন করার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শিশু আইন, ২০১৩–এর ৪৪/১ অনুযায়ী, নয় বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা যায় না। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও নেওয়া যায় না। সে জন্য পুলিশি এজাহারে তাদের প্রত্যেকের বয়স দেখানো হয়েছিল ১২ বছর। প্রথম আলো তাদের পরিচয় লিখেছিল ‘ক’ এবং ‘খ’ শিশু বেনামে। একই বছর জানুয়ারিতে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান খুন হয়। খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় ১৩ ও ১৬ বছর বয়সী দুই কিশোরকে। ২০২০ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে ১১ বছর বয়সী এক শিশু ১০ বছর বয়সী খেলার সাথি আরেক বন্ধুকে গলা টিপে খুন করে। কারণ ছিল শুধুই সামান্য কটূক্তি।

ওপরে উল্লেখ করা সংবাদগুলো শিশুদের হাতে শিশুর খুন হওয়ার যৎসামান্য উদাহরণ মাত্র। এমনিতেই বাংলাদেশে শিশুহত্যার চালচিত্র আতঙ্ককর। অবৈধ সম্পর্ক দেখে ফেলায় মায়ের হাতে শিশু খুন, সম্পত্তির বিরোধে শত্রুকে ফাঁসাতে নিজের সন্তান হত্যা, সাবেক স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে বিরোধের জেরে সন্তান হত্যা ইত্যাকার নানা রকম অস্বাভাবিক শিশুহত্যা-সংবাদও আমাদের পাঠ করতে হয়েছে। অন্যান্য অসংখ্য কারণে হত্যা তো আছেই। ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৪টি শিশু খুন হয়েছিল। ২০২০ সালে ২৯৭টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই খুন হয়েছে ১০০ শিশু। তথ্যটি আইন ও সালিস কেন্দ্রের। কিন্তু মাত্র ৩৬টি শিশুহত্যা পুলিশি মামলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে!

২.

উইলিয়াম গোল্ডিং-এর লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। যুদ্ধের হাত হতে রক্ষা করার জন্য বিমানে করে লন্ডনের শিশুদের নিরাপদ একটি স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু শত্রুদের গুলিতে ভূপাতিত হয় বিমানটি। প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো এক জনমানবহীন জঙ্গলে আটকা পড়ে শিশুরা। শিশুদের একটি সমাজ গড়ে ওঠে। সে সমাজচিত্রটি এঁকে গোল্ডিং শিশু-কিশোর মানসজগতের বহু দিক উন্মোচন করে দেখালেন। সেগুলোর কয়েকটি এ রকম, এক, শিশুরা নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ ও পঙ্কিলতামুক্ত—এমন উপপাদ্য ভুল। দুই, অনিয়ন্ত্রিত রিপুর প্রভাবে তারাও হয়ে উঠতে পারে হিংস্র, ভ্রাতৃঘাতী, নির্দয়-নির্মম, আত্মমগ্ন ও স্বার্থপর ক্ষমতালোভী এবং নেতৃত্ব দখলে মরিয়া। নিজেরাই যখন নিজেদের স্বার্থরক্ষাকারীর ভূমিকায়, তখন তারাও বুনো হয়ে যেতে পারে। নেমে যেতে পারে দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। গোল্ডিং জানান, সামাজিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে না পারা শিশু-কিশোরদের পক্ষে খুনে হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়। ফ্রয়েড এবং এরিক এরিকসনও বলেন, শিশু-কিশোরদের ব্যক্তি হয়ে উঠতে হলে ‘সামাজিক অভিজ্ঞতা’র মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

পাঠ্যপুস্তকে নীতিজ্ঞান বা নীতিশাস্ত্রের পাঠ থাকলেই হয় না। ‘গ্রন্থগত বিদ্যা’ প্রকৃত বিদ্যা নয়। একটি সময় ছিল দেখে শেখার। তিন দশক আগেও শিশু-কিশোরদের জন্য দেখে শেখার মানুষের অভাব ছিল না। পুলিশের বাঁশির শব্দের চেয়ে একজন স্কুলশিক্ষকের গলাখাঁকারি অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। গৃহের নিয়মকানুনে কড়াকড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকত ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, সঠিক-বেঠিক ধরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা, কুসংসর্গ থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে পারা, চোখে চোখ রাখা ইতিবাচক নজরদারি। পরিবার-সদস্যদের পরিবারকে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় নির্ধারিত থাকত। পরিবারের পরপরই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকত। আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিতনির্বিশেষে সমাজের মুরব্বি স্থানীয় যে কাউকে সমীহ করাই ছিল রেওয়াজ। পরিবার ও বিদ্যায়তন শিশু-কিশোর মানসে সেই বোধটিই উজ্জীবিত করে তুলত। আমাদের শৈশবজুড়ে দেখেছিলাম বয়স্ক যে কেউই বলতে পারতেন ‘সন্ধ্যা নেমেছে, বাইরে কেন, ঘরে যাও’। তাদের দূর হতে দেখেও ধূমপানরত তরুণেরা হাতের সিগারেট ফেলে দিত বা লুকিয়ে ফেলত।

৩.

পাশ্চাত্যে শিশুদের হাতে শিশুর খুন হওয়ার উদাহরণ থাকলেও প্রাচ্যে, বিশেষত সার্কভুক্ত দেশগুলোতে, তেমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ১৯৯৬ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ছিল যে দেশটিতে প্রতি পাঁচটি শিশু হত্যার একটি ঘটে থাকে শিশুদের হাতে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ বিশ্বময় ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক দশকের শিশুহত্যার পরিসংখ্যান ও ধরন এবং প্রকরণ উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনটিকে শিশুহত্যা–বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল ধরা হলেও শিশুদের দ্বারা শিশু হত্যার বিষয়টির উল্লেখও নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকা ব্যতীত পৃথিবীর অন্যত্র, বিশেষত এশিয়ায় শিশুদেরই শিশু হত্যাকারী হওয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই। ২০১৬ সালের আগে বাংলাদেশেও শিশুদের দ্বারা শিশুহত্যার তেমন কোনো নজির নেই।

প্রাচ্যে ঘরকেই শিশুদের মূল নিরাপদ আশ্রয়স্থল বিবেচনা করা হয়। তারপর বিদ্যালয়। সামাজিকীকরণের মূল কাজটিও গৃহে এবং বিদ্যালয়েই সম্পন্ন হয়। এ জন্য প্রাচ্যদেশীয় মরমি মূল্যবোধ ও ধর্মাচারকে পশ্চিমা সমাজ বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে পশ্চিমের বাস্তবতা ভিন্ন রকম। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে অনেক ঘরই শিশুর জন্য অনিরাপদ স্থান। শিশুদের বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেও থাকে গৃহ সদস্যদের মাধ্যমে। খুনিদের মধ্যে সৎভাইবোন, সৎমাতা-পিতা বা পারিবারিক বন্ধু মহলের সদস্যরাও থাকে। পশ্চিমের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অভিভাবকত্বের জীবন-জীবিকায় মত্ত থাকা, সংসারে ভাঙন, পরিবারহীনতা এবং বৈবাহিক বন্ধনহীনতার কারণে শিশু–কিশোরদের অনেকের জীবন অনিরাপদ, ভালোবাসা-বিযুক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিপালনজনিত বঞ্চনা যেন শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা বা প্রাণ-সংহারের কারণ না হতে পারে, সে জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো শিশু-কিশোরদের জন্য ‘সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের পরিবেশ সুনিশ্চিত করে। রাষ্ট্র তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়। সেসব পরিবেশও স্বর্গতুল্য কিছু নয়। কিন্তু সেসব প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে শিক্ষা, ক্রীড়া ও শরীরচর্চা এবং মূল্যবোধ ও মানবিক-সামাজিক কাম্য আচরণের প্রশিক্ষণটিই দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে পর্যাপ্ত বিনোদন এবং সৃজনশীলতা বিকাশের উপকরণও থাকে। বিদ্যায়তনও তাদের মূল্যবোধ নির্মাণে বড়সড় ভূমিকা পালন করে। ফলে শিশু-কিশোরদের বড় অংশই তারুণ্যে পা রাখার আগেই আইন ও বিচারব্যবস্থা, বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের প্রতি আচরণ, সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে। এক অর্থে মূল্যবোধ নির্মাণে কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো পাশ্চাত্যের উদারবাদী মানবিক দর্শনের সঙ্গে প্রাচ্যের পরিবার ও সমাজমুখী মরমি দর্শনটিই মিশিয়ে নেয়। প্রাচ্যের এই দর্শনটিই শিশুদের এত দিন সুরক্ষা দিয়ে চলছিল। বর্তমান সময়ে শিশুদের খুনি হয়ে ওঠার খবরগুলোকে আমলে নিলে বলতেই হয় যে সেই দর্শনের ও মূল্যবোধের চর্চায় এবং ‘সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের এলাকাগুলোতে বড়সড় আকারে চিড় ধরেছে।

শিশুদের হাতে শিশু খুন হওয়ার ঘটনাগুলো কি শুধুই আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত? উত্তর ‘না’। হত্যা-ঘটনাগুলো এই স্পষ্ট ইঙ্গিতটিই দেয় যে শিশুদের ‘সামাজিক অভিজ্ঞতা’ লাভের ক্ষেত্রগুলো দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। জ্যামিতিক হারে খেলার মাঠ ও লাইব্রেরি কমছে, বহুতল ভবন বাড়ছে। শিশু-কিশোরদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের গণ্ডিগুলোও ছোট হয়ে আসছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে যে ‘শিশু-দারিদ্র্য’ বাড়ছে এবং শিশুরা ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র্য’র (মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি) শিকার। তার প্রমাণ শিশু-কিশোরদের উন্নয়ন খাতে প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য বাজেট-বরাদ্দকরণ। বাংলাদেশের এ বছরের বাজেটেও পশ্চাৎপদ (অর্থাৎ দরিদ্র) কিশোর-কিশোরীদের জন্য কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ রাখার ইঙ্গিত মিলছে। শুধুই গুটিকয় শিশু-কিশোরের অন্ন-সংস্থানের ভাবনায় ভাবিত বাজেট-বরাদ্দ কিশোর উন্নয়নের কোনোই কাজে আসবে না। এ জন্য রাষ্ট্রের সুমতি দরকার। আসন্ন বাজেটটি শিশু-কিশোরবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। শিশুদের ‘সামাজিক অভিজ্ঞতা’ লাভের পরিবেশ নির্মাণে রাষ্ট্রের একাগ্রতাও দরকার।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়