করোনা অতিমারির ধাক্কা দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ প্রতিটি খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সাময়িক সাফল্যও এসেছে। ব্যতিক্রম শিক্ষা খাত, কারণ শিক্ষা পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি, তাই কোনো সাফল্যও আসেনি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার যেসব খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা ছিল ২২ শতাংশ (১৭৩ কোটি টাকা)। ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয় সে সময়ে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তায় মনে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। আমরা ভেবেছিলাম রূপকল্প ২০২১ থেকে ২০৪১ বা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যাওয়ার জন্য শিক্ষা খাত নিয়ে সরকারের নানা পরিকল্পনা থাকবে এবং বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটবে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ—অর্থাৎ চলমান প্রক্রিয়ার সবই অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন, শুধু শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নেই। বাজেটে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, উন্নয়ন, পদোন্নতি প্রভৃতি দিকনির্দেশনা থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল চালু রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই। শিক্ষা নিয়ে এই পরিকল্পনাহীনতা একটি প্রজন্মকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, যা বাজেটের মূল বক্তব্য ‘সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ স্লোগানকে বাধাগ্রস্ত করবে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা এসেছে, যার সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য খাতের টাকা বা টাকার অংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে ৫ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা এবং শতকরা হিসাবে শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। এবারের বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকাসহ শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা এসেছে, যার সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য খাতের টাকা বা টাকার অংশ। সুতরাং এই সাড়ে আট হাজার কোটি টাকাকে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ খাত নাম দিয়ে শতকরা ও টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এটি পুরোপুরি গোঁজামিলের হিসাব এবং সামগ্রিক শিক্ষা খাতকে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা।
বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে করোনাকালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সবাই, সেখানে বাড়তি কর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের আরও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, এমনকি তাঁদের শিক্ষা চলমান রাখাও দুষ্কর হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা কোনাভাবেই কাম্য নয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা আছে, কিন্তু আমরা এখনো তা থেকে অনেক দূরে আছি। জাতীয় বাজেটের হিসাবে বা জিডিপি উভয় ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অর্ধেক বা অর্ধেকের সামান্য বেশি। আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে তাকাই, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল—সবাই শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
করোনা বিপর্যয় থেকে ‘শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুদ্ধার’ কার্যক্রম চালাতে যে বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল, তার কোনো নির্দেশনা প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। গত দেড় বছরে শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের মন্ত্রণালয়ের যে পরিকল্পনা ছিল, তার জন্য কোনো বরাদ্দ এ বাজেটে নেই। এবারের বাজেটে জীবন ও জীবিকাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে শিক্ষা খাতকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। এই বাজেটের মাধ্যমে হয়তো জীবন চলবে, জীবিকাও বাড়বে এবং কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু মানব-সক্ষমতা বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। অর্থমন্ত্রীর যে বাজেট বক্তৃতায় মূল প্রতিপাদ্য, সেটিও হোঁচট খাবে। সুতরাং গুরুত্ব বিবেচনায় শিক্ষা পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষা খাতে যথাযথ বরাদ্দ আশু প্রয়োজন। একই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারকেও করোনা বিপর্যয় থেকে শিক্ষা উদ্ধারের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো মৌলিক দায়িত্ব।
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান লেখক ও গবেষক