শাহ আলমের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা

অধ্যাপক শাহ আলম
ছবি: সংগৃহীত

আমার মস্কোর ছাত্রজীবনের শেষ দুই বছর হোস্টেলের ৪০৪ নম্বর রুমে থাকতাম। অধ্যাপক শাহ আলম বা আমাদের সবার শাহ আলম ভাই থাকতেন ৫০৪ নম্বর রুমে। হোস্টেলের একতলা ওপরে-নিচে। শাহ আলম ভাই গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে, আমি ১৯৭৩ সালে। তাঁর মাস্টার্স শেষ হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। মাস্টার্স শেষ করে শাহ আলম ভাই আমাদের সবার আগে তৎকালীন সেই প্যাট্রিস লুবুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হলেন এবং সেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন আশির দশকের প্রথম দিকে।

মিজান (জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান) শাহ আলম ভাইয়ের মৃত্যুর খবর টেলিফোনে জানাল। ৩১ আগস্ট রাত ১০টার দিকে শাহ আলম ভাই চলে গেলেন। মিজান গিয়েছিল আমারও দুই বছর পরে। শাহ আলম ভাইয়ের মতো মিজানও মাস্টার্স শেষ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আইনে পিএইচডি করেছিল। দুজনেই পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর পর মিজান এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শাহ আলম ভাই গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রথম ডিন হয়ে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ২৫ বছরেরও বেশি আইন পড়িয়েছেন। ২০০০ সালের দিকে এক বছর এবং তার পরে ২০০৯ সালের শেষ বা ২০১০ সালের শুরু থেকে বছর দু–তিন আগপর্যন্ত সব মিলিয়ে আট থেকে নয় বছর ছিলেন বাংলাদেশ আইন কমিশনের সদস্য। মাঝে কিছুদিন আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও ছিলেন।

আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইনের বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখেছেন। শেষের দিকে মুসলিম আইন নিয়েও বই লিখেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধও অনেক। মাঝেমধ্যে দ্য ডেইলি স্টারেও কলাম লিখেছেন, প্রথম আলোতেও গুটিকয়েক কলাম লিখেছেন।

আইন কমিশনে কাজ করার বছরগুলোয় আইন সংস্কারের জন্য নিজ উদ্যোগে অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছিলেন। চাইতেন এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হোক, কিন্তু শেষের দিকে আইন সংস্কারসংক্রান্ত রিপোর্টগুলো আইন কমিশনেই পড়ে থাকত, এতে শাহ আলম ভাই আশাহত হয়ে কাজের উদ্যম হারিয়ে ফেলেছিলেন।

কয়েক বছর আগে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে উৎসাহ–উদ্দীপনায় কিছুটা ভাটা পড়ে। মাস তিনেক আগে আবারও সেই ব্যাধি। এবার আর সেরে উঠতে পারলেন না।

দুই.
১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের আগস্ট—ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৪৭ বছর। ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, রাস্তাঘাটের খানাখন্দ, কাজের চাপসহ আরও আনুষঙ্গিক নানা সমস্যায় আজকাল আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক শীতল। আমাদের পুরোনো কোনো বন্ধু বিদেশ থেকে এলে শাহ আলম ভাইয়ের অফিসে লাঞ্চের দাওয়াত পড়ত। অথবা মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় মস্কো-দিনের বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় রাজা–উজির মারা হতো অনেক রাত পর্যন্ত। আমরা যারা সত্তরের দশকে মস্কো গিয়েছিলাম, তাদের অনেকেই এই সরকারের আমলে বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু অলিখিতভাবে শাহ আলম ভাই ছিলেন সবার মুরব্বি। সমস্যা বলে তারপর এখন কী করব, এই প্রশ্ন নিয়ে টেলিফোন কত লোক যে শাহ আলম ভাইকে করেছে, সেটা তো শাহ আলম ভাই ছাড়া আর কেউ কখনো বলতে পারবে না।

তিন.
ইদানীংকালের দুটো ঘটনার উদাহরণ দিয়ে শাহ আলম ভাইকে স্মরণ করব। এপ্রিলের ঘটনা। মিজান ফোনে বলল, শাহ আলম ভাইয়ের আবার স্ট্রোক হয়েছে। এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরে কোথাও ভর্তি করানো যাচ্ছিল না। তখন তো ছিল করোনাকালের প্রথম দিকের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দুর্যোগের সময়। শেষ পর্যন্ত আগারগাঁওয়ের এক নতুন সরকারি হাসপাতালে তার ঠাঁই হয়েছিল। মিজান আমাকে বলেছিল, সেখানে ভর্তি করতে চরম অস্ত্রটি সে ব্যবহার করেছিল।

শাহ আলম ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আজকাল প্রথম পরিচয়ে অনেকেই পরিচয় দেন আমার বাবা, ভাই, চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আর আমরা ভুলতেই বসেছিলাম যে শাহ আলম ভাই সত্যিকারের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বলতেন না, দাবি করতেন না, কখনো কাউকে মনে করিয়ে দিতেন না। শুধু ১৯৭১ সালে না, সারা জীবনই দেশের জন্য কাজ করেছেন।

দ্বিতীয় ঘটনার দিন, তারিখ, সংখ্যা, অঙ্কে কিছুটা হেরফের হতে পারে, তবে সেটা মুখ্য নয়। সম্ভবত বছর দুই আগের কথোপকথন। টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে শাহ আলম ভাই জানালেন যে দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন শেষে আট অঙ্কের যে অবসর ভাতা, অর্থাৎ টাকা পেয়েছিলেন, তার প্রায় সবটাই কয়েক মাস আগে তিন–চারটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করে দিয়েছেন। হাতে মাত্র কয়েক লাখ টাকা রেখেছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে জানলাম বাকি যে কয়েক লাখ টাকা ছিল, সেটাও নাকি দান করে দিয়েছেন।

আজকাল একদিকে প্রতিনিয়ত শুনি ‘মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ’ আরেক দিকে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় পড়ি শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা। যারা এসবে ব্যস্ত, তারা হয়তো দু–চার বছরের জন্য প্রতিপত্তি ক্রয় করতে পারে, মনে করতে পারে মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করে, এমনকি ভালোও বাসে। শাহ আলম ভাই মুক্তিযুদ্ধের ঢাকঢোল পেটাননি, যা টাকাপয়সা ছিল তাও বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানি, তাঁর অগণিত ছাত্র ছাত্রী, সহকর্মী আর বন্ধু-বান্ধব তাঁকে আজীবন শ্রদ্ধা করবে ও ভালোবাসবে।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক