লেখক চেনার কত উপায়

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আজকের দিনে লেখকের শ্রেণিবিন্যাস করা একান্ত জরুরি। কারণ, আপনি একটি–দুটি বই বের করলেন বা এক ডজনই করে ফেলেছেন, তখন আপনাকে সঠিক কী নামে ডাকা হবে? অথবা আপনি লেখক/সাহিত্যিক শ্রেণিবিন্যাসের কোথায় অবস্থান করছেন? এমনও হতে পারে, একটি শ্রেণিতে আপনি পড়েন না। দুটি বা তিনটি দিয়ে আপনার লেখার কার্যক্রমকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। আপনি যদি এই সমস্যায় না-ও পড়ে থাকেন, আপনার বন্ধু বা ভাবি বা খালু এই সমস্যায় পড়েছেন। আধুনিক সমাজে, বাঙালি বিবেচনা করলে একজনের গড়ে ২৯ জন নিকট মানুষ থাকার কথা। কেউ কেউ অফিসের কলিগও হতে পারে। বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটেও হতে পারে। তাদের সমস্যায় আপনার কিছু না কিছু কর্তব্য আছে। কাজেই ব্যাপারটি একটু খতিয়ে দেখা দরকার।

সবকিছুর শ্রেণিবিন্যাস আছে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ট্যাক্সোনমি। ফলের ট্যাক্সোনমি আছে, ফুলের আছে, বিড়ালের আছে, আপনি একটা ডিগ্রি নেবেন, তারও তো ট্যাক্সোনমি আছে। বিজ্ঞান না কলা? বিজ্ঞান হলে তারপর জীববিজ্ঞান না প্রকৌশলবিদ্যা। তাহলে লেখকের ট্যাক্সোনমি থাকবে না কেন?


আপনি একটা কবিতা লিখলেন। ওদিকে আপনি নিজেই গান করেন, কবিতায় নিজেই সুর দিয়ে দিলেন। আপনি কি কবি, না গীতিকার? না কবিকার? ট্যাক্সোনমিতে একটা থেকে আরেকটার সম্বন্ধ দেখানো হয়। ধরুন, মার্জার হলো ‘পরিবার’, তার নিচে দেখানো হলো একদিকে বিড়াল, আরেক দিকে বাঘ। অর্থাৎ মার্জারের একটা অংশ হলো বিড়াল, তারও নিচে দিতে পারেন, বনবিড়াল, মেনিবিড়াল, সেটা হবে উপপ্রজাতি। এখানে পুরোই ওপর থেকে নিচে সম্বন্ধের ডালপালা বোঝা যাচ্ছে। লেখক–সাহিত্যিকের এমন একটা সম্বন্ধসূচক ট্যাক্সোনমি নেই কেন, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। যেখানেই কোনো বিষয়ের ভিন্নতা আছে এবং বিষয়ের প্রাচুর্য আছে, সেখানেই ট্যাক্সোনমি দরকার। লেখার রকমফের অনেক। কত, তা একটু পরেই দেখছি। সেখানে ট্যাক্সোনমি না হলেই চলে না। যেমন কবি আর ছড়াকারের সম্পর্ক কী? পাশাপাশি? দুটো আলাদা শাখার মানুষ? কাজিনের মতো? নাকি কবিতার উপশাখা ছড়া, নাকি ছড়ার উপশাখা কবিতা? গল্পকার কি সাহিত্যিক? নাকি সাহিত্যিক গল্পকার? তারপর কথাশিল্পী?

আমার দেখা মতে বেশির ভাগ লেখকই এই নিয়ে ধন্দে পড়েন।

অনেকে আবার দু–তিনটা প্রজাতি ব্যবহার করেন, যেমন কবি, লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক। চারটাই করছেন, একটা বাদ দিলে তার লেখার পুরো পরিচয়টা মিলছে না। এখানে যদি এর ওপরের একটা শ্রেণিবিভাগ থাকত, ধরেন কলেসাগ, তাহলে চারটা পরিচয় এক শব্দে পাওয়া যেত। সবাই এক কথায় বুঝে ফেলত, তার এই শ্রেণিবিভাগের নিচে আরও চারটি উপশ্রেণিবিভাগ আছে, তিনি সব কটিতেই সিদ্ধহস্ত। আমি এ নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার নিজের শ্রেণিবিভাগ পেয়ে যাওয়ায় আমি আর গবেষণায় উৎসাহ পাচ্ছি না। তবে একটা কাজ করতে পারি, আমার তালিকায় যত ধরনের লেখক পাওয়া গেল, তা নিচে দিয়ে দিই। ক্যাটাগরিগুলো সবার জানা আছে, কিন্তু কাজের সময় হয়তো দেখা গেল মাথায় আসছেন না। এক জায়গায় লিপিবদ্ধ থাকা ভালো।

আশা করি, আমার অসমাপ্ত কাজ অন্য কেউ সমাপ্ত করবেন এবং আমাকেও ‘গবেষক’ হিসেবে সেখানে ক্রেডিট দেবেন।

নিচে বিভিন্ন ধরনের লেখক/সাহিত্যিক এবং তাঁদের সংজ্ঞা দেওয়া হলো।

কবি—প্রধানত যিনি কবিতা লেখেন। কবি ছড়া লিখলেও কবি থাকেন।

ছড়াকার—প্রধানত যিনি ছড়া লেখেন। ছড়াকার কবিতা লিখলেও ছড়াকার থাকেন।

গল্পকার—যিনি প্রধানত ছোট বা বড় গল্প লেখেন। গল্পকার অল্প কিছু উপন্যাস লিখলেও গল্পকার থাকেন।

ঔপন্যাসিক—যিনি প্রধানত উপন্যাস লেখেন। তিনি অবশ্যই গল্পও লিখে থাকেন, কিন্তু গল্পকারের দলে চলে আসেন না।

গবেষক—যিনি গবেষণা করেন (বিজ্ঞানের গবেষণা এখানে বলা হচ্ছে না, সাহিত্য বা সমাজবিষয়ক গবেষণা) এবং গবেষণা লিখিত আকারে সাধারণের জন্য প্রকাশ করেন।

প্রাবন্ধিক—যিনি প্রধানত বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লখেন (ননফিকশন)। প্রাবন্ধিককে মনে হয় সাহিত্যিক বলা হবে না। কেন হবে না, তা জনি না।

কথাসাহিত্যিক—আমার ধারণা, যিনি গল্প–উপন্যাস লেখেন, তিনি কথাসাহিত্যিক। কবি কথাসাহিত্যিক নন। কেন নন, জানি না।

কথাশিল্পী—কথাসাহিত্যিক আর কথাশিল্পী কি একই? জানা নেই।

শিশুসাহিত্যিক—যিনি শিশুদের জন্য গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা লেখেন, তিনি শিশুসাহিত্যিক। উল্লেখ্য, শুধু কবিতা লিখলে আপনি কবি, সাহিত্যিক বলা হবে না। কিন্তু ছোটদের জন্য একটা শাখায় লিখলেও আপনি শিশুসাহিত্যিক। আরেকটা ব্যাপার, একবার শিশুসাহিত্যিক হয়ে গেলে আপনি বয়স্কসাহিত্যিক হতে পারবেন না। মানুষের জীবন শিশু থেকে যুবা হয়, কিন্তু লেখক ক্যাটাগরিতে শিশুসাহিত্যিক বয়স্কসাহিত্যিক হন না। বয়স্কসাহিত্যিক হতে হলে উল্টো দিক থেকে শুরু করতে হবে। আগে বয়স্কসাহিত্যিক হতে হবে, তারপর শিশুসাহিত্য লিখলেও শিশুসাহিত্যিক ক্যাটাগরিতে পড়বেন না।

সায়েন্স ফিকশন লেখক—যিনি প্রথম ধাক্কায় কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে আবার বইয়ের নামে অজানা শব্দ থাকতেই হবে। যেমন ‘ইটি’ অথবা ‘রু ও রি’, এমন। সায়েন্স ফিকশন লেখক সাহিত্যিকের ক্যাটাগরিতে পড়ে না বলে মনে হয়। কেন সেটা জানি না।

নাট্যকার—এই বিষয়টা একটু জটিল। মনে হয় শুধু নাটক লিখলেই হবে না, নাটকের সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে। তবেই নাট্যকার। যেমন, রবীন্দ্রনাথকে কেউ নাট্যকার বলেন না। সৈয়দ শামসুল হককেও না। হ‌ুমায়ূন আহমেদকেও নাট্যকার বলা হয় না। সন্দেহ নিরসনের জন্য বিখ্যাত নাট্যকার ইবসেনের নাম দিয়ে গুগল সার্চ করতে বেরিয়ে এল, তিনি একজন অন্যতম নাট্য পরিচালক ছিলেন। ব্যাপারটা নিরসন তো হলোই না, আরও জটিল হয়ে গেল।

রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক—এটা মনে হয় বেশ সহজ। এখানে সংজ্ঞার প্রয়োজন দেখছি না, উদাহরণ দিলেই হচ্ছে। কাজী আনোয়ার হোসেন, লাল মোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু।
গীতিকার—গান লিখলে গীতিকার, কিন্তু কবিতা লিখে সেই কবিতা পরে গান হলে গীতিকার নন। ওপরের নাট্যকার বিষয়টাও এখন মনে হচ্ছে তাই। থাক, ওটা আর শুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম না।

ইতিহাসবেত্তা/ঐতিহাসিক—যিনি ইতিহাস জানেন, গবেষণা করেন এবং লেখেন। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার পরেও তিনি গবেষক ক্যাটাগরিতে পড়ছেন না বলেই আমার ধারণা।

অনুবাদক—যিনি প্রধানত অনুবাদ করেন। আপনি কবিতা অনুবাদ করেন, অথবা গাড়ি চালানোর কোনো নির্দেশিকা অনুবাদ করেন, শ্রেণিবিভাগ কিন্তু একই থেকে যাচ্ছে।

রম্য লেখক—এখন সন্দেহ হচ্ছে, এই শ্রেণিবিভাগ আছে কি? কেউ কি শুধু রম্যই লেখেন?

সাংবাদিক—সংবাদ অবশ্যই লেখা। কাজেই এটা লেখকের আরেকটা ধরন। কিন্তু সব সংবাদ নয়। ‘আসমা বৃত্তি পাইয়াছে’—এই সংবাদ লেখক হয়তো লেখক/সাহিত্যিক ক্যাটাগরিতে পড়েন না।

কলামিস্ট—এবার ক্যাটাগরিটা ইংরেজিতে। বাংলা কী হবে? যদি বাংলা না থেকে থাকে, তাহলে ধরেই নিতে হবে এটা নতুন ক্যাটাগরি। আবহমান কাল ধরে বাংলা ভাষায় ছিল না। যিনি সংবাদপত্রে বা ম্যাগাজিনে ফিচারধর্মী লেখা লেখেন, তিনি কলামিস্ট।

লেখক—ওপরে অনেককে শুধু লেখক বললেই হয়। কিন্তু সবাইকে নয়। কবিকে লেখক বলা যাবে না, গীতিকারকেও না। নাট্যকারকে কি লেখক বলা যাবে? জানি না।

কথা থেকে যাচ্ছে, কে সাহিত্যিক দাবি করতে পারেন? সবাই? ওপরে প্রাবন্ধিককে সাহিত্যিক ক্যাটাগরি থেকে বাদ দিয়েছিলাম। না জেনেই। এখন বুঝতে পারছি, সেটা অবশ্যই সাহিত্যের একটা প্রধান ক্যাটাগরি। রবীন্দ্রনাথও প্রবন্ধ লিখেছেন। বেশ খারাপ লাগছে, কিন্তু ওপরে উঠে আবার মুছতে ইচ্ছা করছে না। প্রাবন্ধিক ভাইবোনেরা, নিজগুণে ক্ষমা করবেন। সায়েন্স ফিকশন লেখক ভাইবোনেরা, আপনাদের কাছেও একই আবেদন। এখন মনে পড়েছে, জুলভার্ন তো সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন। তিনি একজন বিরাট সাহিত্যিক! তাহলে যে যা–ই বলুক, সায়েন্স ফিকশন একটা সৃজনশীল সাহিত্য হতেই হবে।

কাজেই বুঝতেই পারছেন, তাড়াহুড়োর মধ্যেও বেশ একটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে অনেক কিছু উদ্‌ঘাটন করা হলো, অনেক কিছু আবার অনুদ্‌ঘাটিত থেকে গেল। গবেষণা হচ্ছে একটা কাঠিদৌড়ের মতো। আমি যেখানে থামব, সেখান থেকে আরেকজন কাঠি হাতে নিয়ে ছুটবে। তফাত হলো কাঠিদৌড়ে আগের পরের সবাই, পুরা টিম পুরস্কার পায়। গবেষণায় পায় সব শেষের জন। আগের গবেষকগুলো হাপিস হয়ে যায়। এই হলো জগতের নিয়ম।

মোস্তফা তানিম: প্রকৌশলী ও লেখক।