মিয়ানমারের জান্তাদের গণহত্যা থেকে যে রোহিঙ্গারা কোনোরকমে পালিয়ে এখনো বেঁচে আছেন, সেই রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্ট দিনটিকে ‘গণহত্যার স্মরণ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন একজোট হয়ে বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত লঘু অপরাধ হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা করেছে, তা দেখে আমি যারপরনাই ধাক্কা খেয়েছি। স্তম্ভিত হয়েছি।
ঠিক ওই দিনে (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের দূতাবাস টুইট করেছে, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের আজ চতুর্থ বার্ষিকী।’ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই দিন একটি সংবাদ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। ওই বিবৃতির শিরোনাম ছিল, ‘রাখাইন রাজ্যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের চতুর্থ বার্ষিকী পালন’। বিবৃতির প্রথম লাইন ছিল, ‘চার বছর আগের এই দিনে উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বার্মার সামরিক বাহিনী ভয়াবহ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল।’
লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সচেতনভাবে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা ‘জাতিগত শুদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ শব্দটি এড়িয়ে গেছে।
পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দেশগুলো, বিশেষ করে অ্যাংলো-আমেরিকান সরকারগুলো মানবাধিকারের মূলনীতিগুলো এবং কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডসহ (সিপিপিসিজি) বিভিন্ন মানবাধিকার সনদকে তাদের ভূরাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। তারা তাদের চোখে এসব ইস্যুকে নিজের মতো করে দেখে। যেমন মিয়ানমারের গণহত্যাকে তারা নিজেদের স্বার্থে গণহত্যা হিসেবে দেখে না।
ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেন তার বাজার ধরে রাখা, নতুন নতুন বাজারে ঢোকা এবং উদীয়মান বাজার থেকে মুনাফা তুলে আনার বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেই দিক থেকে মিয়ানমারকে তারা তাদের উদীয়মান বাজার হিসেবে নৈতিক সমর্থন দিতে চায়।
ওয়াশিংটন ও লন্ডন কার্যত রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে যে মানুষগুলো উপমানবের মতো বেঁচে আছে, সেই মানুষগুলোর মৌলিক মানবাধিকারের স্বীকৃতি এ দুই পরাশক্তি দিতে অস্বীকার করেছে।
‘জাতিগত শোধনাভিযান’—এই শব্দবন্ধের উদ্ভাবক হলেন সার্বিয়ার কুখ্যাত গণহত্যার খলনায়ক স্লোবোদান মিলোসেভিচ। সেই নৃশংস গণহত্যাকারীর উদ্ভাবিত শব্দবন্ধটি দিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যার মতো অপরাধকে লঘু করে ফেলার ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অপমান করেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর যে রোহিঙ্গারা নৌকায় করে সাগরপথে বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের উপকূলে গিয়ে সেসব দেশের নৌবাহিনীর তাড়া খেয়ে ফের সাগরে এসে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের সবার আত্মার প্রতি এর মাধ্যমে অবমাননা করা হয়েছে।
চীন, লিবিয়া, সিরিয়া—এ ধরনের শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর বিষয়ে যুক্তরাজ্যের উদারপন্থী ও রক্ষণশীল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয় নেতারা নিয়মিত ‘গণহত্যা’ কথাটি ব্যবহার করে থাকে। তঁারা বলেন, সিরিয়ায় আসাদ বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে, জিনজিয়াংয়ে চীন সরকার উইঘুরদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। আর এখন দেখা যাচ্ছে ওয়াশিংটন ও লন্ডন রোহিঙ্গাদের গণহত্যার স্বীকৃতির দাবির বিরুদ্ধে এক হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে।
জেনোসাইড কনভেনশন গণহত্যার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, বাইডেন প্রশাসন দাপ্তরিকভাবে সেই সংজ্ঞায় রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ও ইউএস সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনদেজ এবং দেশটির প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য গ্রেগরি ডব্লিউ মিক্স প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনিভাবে অপরাধ সাব্যস্ত করতে আহ্বান জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবসে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন জেনোসাইড মেমোরিয়াল ইভেন্ট শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশ্বনন্দিত আইনজ্ঞ ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্ট্যানটোন তাঁর নিজের লেখা ‘হোয়াট ইজ জাস্টিস?’ (ইনসাফ কাকে বলে?) শিরোনামের একটি কবিতা পাঠ করেন। ওই কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘যে উকিল একে এখনো গণহত্যা বলছে না, তার কাছে ন্যায়বিচার মানে কী?’
গ্রেগরি স্ট্যানটোনের গণহত্যাবিষয়ক একটি বই শিগগিরই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিতব্য সেই বইয়ে তিনি বলেছেন, গণহত্যাকে চাতুর্যের সঙ্গে অস্বীকার করতেই ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ টার্মটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেখানে তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো, মানবাধিকার গ্রুপগুলো এবং বহু সরকার এখনো মিয়ানমারের গণহত্যাকে বারবার জাতিগত ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ বলে যাচ্ছে। কুখ্যাত মিলোসেভিচের উদ্ভাবিত এই টার্ম সাধারণত জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের’ কোনো আইনগত অর্থ নেই। কোনো আন্তর্জাতিক সনদে এটিকে বেআইনি বলে নির্ধারণ করা হয়নি। কোনো জাতীয় দণ্ডবিধিতে ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’কে নিষেধ করা হয়নি। কোনো কৌঁসুলির পক্ষে কারও বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা সম্ভব হবে না। তার মানে এই টার্মটি সুস্পষ্টভাবে অপরাধীকে দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার লাইসেন্স।
মিলোসেভিচ যেভাবে ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ কথাটিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এই টার্ম ব্যবহার করতেন, জাতিসংঘ, সংবাদমাধ্যম ও অনেক দেশের নীতিনির্ধারকেরা ঠিক একইভাবে টার্মটি ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে গণহত্যাকারীদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজের পণ্ডিত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এই দিক উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যাকে আইনগত মর্যাদা দিয়ে গণহত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে নিতে ‘সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন’ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেকোনো সাধারণ মানুষই বুঝতে পারবে এটি সুস্পষ্ট গণহত্যা। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে এটি গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করে নিতেই হবে। গায়ত্রীর এ কথা মানবতার কথা। নিজেদের মানুষ হিসেবে স্বীকার করলে এ গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিতেই হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মং জার্নি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী