মতামত

রোজিনা নির্যাতন প্রশ্নে নিরাপস সাংবাদিক সমাজ

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে আটকে রাখা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রসঙ্গে একটি লেখা লিখেছেন এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু। লেখাটিতে প্রথম আলো প্রসঙ্গে তাঁর কিছু অভিযোগ ও মন্তব্য রয়েছে। সে কারণে লেখাটির সঙ্গে প্রথম আলোর বক্তব্য হিসেবে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ-এর লেখা ‘প্রথম আলো নিয়ে অমূলক অভিযোগ’ প্রকাশিত হলো

শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা নয়, আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে ‘শূন্যসহ’ নীতি গ্রহণ করতে হয়, তা না হলে খোদ রাষ্ট্রই টিকে থাকবে না। একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন ভেজালবিরোধী কিংবা অন্য কোনো অভিযানে যান, একা হলেও তিনিই তখন ‘রাষ্ট্র’। ব্যবসায়ী সমাজ কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠী এককাট্টা হয়ে সংখ্যাধিক্যের জোরে সহজেই তাঁকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারে, কিন্তু এ রকম বিচ্ছিন্ন দু-একটা চেষ্টায় সরকার এতটাই কঠোর অবস্থান নেয়, যেন কেউ ভবিষ্যতে এ ধরনের দুঃসাহস আর না করে। অনুরূপভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমিতসংখ্যক সদস্য যখন কোনো লোকালয়ে অপরাধী ধরতে যান, এলাকাবাসী জোট বেঁধে বাধা দিলে তাঁরা কিছুতেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। ‘ডাকাত পড়া’র গুজব ছড়িয়ে এ রকম দু-একটা চেষ্টা যে ঘটেনি তা নয়। সেসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করেছে। ঠিক একইভাবে সাংবাদিকেরা যখন একেবারে একা খালি হাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে যান, অপকর্মকারীরা যদি সংঘবদ্ধভাবে তাঁকে আক্রমণ করার সাহস পেয়ে যায়, তাহলে প্রত্যেক সাংবাদিকেরই অকুস্থলে জীবন বিসর্জন দিতে হবে।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির উদ্যোগে সমাবেশে সাংবাদিকেরা। ১৯ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচায়

এবার রোজিনার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে, প্রতিকার করা না গেলে ভবিষ্যতে হয়তো মাথা কামিয়ে ঘোল ঢেলে দেওয়া হবে। এবার ছয় ঘণ্টা পর হলেও পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে, আগামী দিনে ‘ছুটির ঘণ্টা’র মতো টয়লেটে আটকে রাখা হতে পারে।

কিছুদিনের মধ্যে প্রতিটি দপ্তরে ‘এমএলএসএস’ নামে ‘বাউন্সার’ নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে মাটির সঙ্গে লুটিয়ে ফেলা হলে সবচেয়ে বিপদে পড়বে রাষ্ট্র নিজেই, তথ্য জানা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হবে সরকার ও নাগরিকেরা। এ ছাড়া রোজিনার বিরুদ্ধে যে ‘তামাদি’ আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে এবং প্রথম কদিন জামিন না দিয়ে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মধ্যে যে যোগসাজশ প্রতীয়মান হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের ভারসাম্যই হুমকির মুখে পড়েছে। আর এ কারণেই সাংবাদিক-সুধী সমাজ রোজিনা-নিগ্রহের ঘটনায় এত বেশি সোচ্চার! এখানে রোজিনা কোন পত্রিকায় কাজ করেন, সেটা একেবারেই বিবেচ্য নয়। বিষয়টি তার চেয়ে অনেক বড়, একেবারে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন! অন্য যেকোনো গণমাধ্যমের সাংবাদিকের ক্ষেত্রেও সবাই একইভাবে প্রতিবাদ করত, একইভাবে রাস্তায় নামত।

অন্যদিকে এ ঘটনায় ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর ভূমিকাও অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তারা যেখানে কোনো সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ আকারে প্রচার করতে পারদর্শী, তারাই-বা এত বড় একটা খবর ছয় ঘণ্টা ধরে চেপে রাখল কেন? সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতারা পরিস্থিতিটি জানতে পারলে নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে যেতেন এবং একটা সুরাহার চেষ্টা করতেন। জাতীয় প্রেসক্লাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মাত্র ৫০ কদম দূরে এবং দুপুরের খাওয়ার সময় বহু সাংবাদিক নেতাই তখন ক্লাবে ছিলেন। তাহলে প্রথম আলো নিজেই কি বিষয়টিকে এ পর্যায়ে বাড়তে দিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিয়ে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছে?

এক-এগারোর আমলে ‘মাইনাস টু’ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে ড. ইউনূসের সঙ্গে মিলে রাজনৈতিক দল গঠন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বন্ধে প্রকাশ্য দৌড়ঝাঁপ ও ভোটের পরদিন তাদের প্রথম পাতায় নারী ভোটারদের কপালে সিঁদুর চড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতপূর্ণ খবর ছাপানো, যশোরে গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশের স্থান হিসেবে রামকৃষ্ণ মিশনের নাম জুড়ে দিয়ে সারা দেশের মিশনগুলোতে মৌলবাদীদের আক্রমণ উসকে দেওয়া, শাহবাগে আন্দোলনরত নারীদের চরিত্র হনন করা গল্প প্রকাশ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশ পত্রিকার ডানপন্থী পাঠকদের বাজার ধরার চেষ্টা এবং তাদের নিজেদের অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্কুলছাত্র আবরারের মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়াসহ উল্লিখিত প্রতিটি অভিযোগ এত দিন ডেইলি স্টার-প্রথম আলো তাদের বিরুদ্ধে সরকারের নগ্ন হামলা হিসেবে প্রচার করে এসেছে। রোজিনা নির্যাতনের ঘটনাকে তারা নাকি এখন সেসব দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে হাজির করছে। আন্দোলনকারীরাই কি তবে তাদের এ পথ করে দিয়েছে? সরকারই-বা তাদের এত বড় সুযোগ হাতে তুলে দিল কেন?

সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে একপর্যায়ে রোজিনাকে মুচলেকা দেওয়ার কথা বলতে শোনা গেছে, যা এখন খণ্ডিতভাবে ব্যাপক প্রচারও করা হচ্ছে। এ প্রস্তাবই-বা তখন গ্রহণ করা হলো না কেন? হাতেনাতে যদি তাঁকে ধরাই হয়ে থাকে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশে হস্তান্তর না করে, ছয় ঘণ্টা আটকে রাখার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বস্তুত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব এবং কতিপয় আমলার ঔদ্ধত্যই এ ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এ সরকারের ভেতরে উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু মন্ত্রী এবং ‘এরশাদ-খালেদা জিয়া’র আমলে পিএসসি পার হওয়া কতিপয় আমলার বাড়াবাড়ি বেশ কিছুদিন ধরেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাংবাদিক সমাজ যখন রোজিনার ওপর আক্রমণকে সব সাংবাদিক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর চরম আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে আন্দোলন করছে, সম্পাদক পরিষদ তখন ঘটনাটিকে কেবল একটা পত্রিকার কণ্ঠরোধের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে বিবৃতি দিল! কেউ কেউ দেশের ভেতর কোনো জনমত তৈরির চেষ্টা না করে সোজা চলে গেলেন বিদেশি বন্ধুদের কাছে। এত দিন তারা অভিযোগ করে এসেছে, সরকার নাকি ডেইলি স্টার-প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দিতে বাধা দিচ্ছে। যেখানে সাংবাদিক সমাজ নিজ উদ্যোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস কনফারেন্স বর্জন করেছে, সেখানে ডেইলি স্টার তাদেরই প্রেসনোট চাররঙা বিজ্ঞাপন আকারে ছেপে এ সুযোগে সরকারি বিজ্ঞাপনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল না তো? অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবারই প্রথম নয়, কিছুদিন আগেও একাত্তর টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনের বিপক্ষে লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল। এ মন্ত্রণালয়ে পাবলিসিটি বাজেট খরচেও অনেক দুর্নীতির কাহিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।

তা ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক এভাবে আক্রান্ত হলে ডেইলি স্টার-প্রথম আলো কিংবা তাদের সাংবাদিকেরা কি নির্যাতিতের পাশে এসে দাঁড়াত? তাদের নাকি বড় ধরনের জাত্যভিমানও রয়েছে! রোজিনার মুক্তির পর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আন্দোলনরত সাংবাদিকদের ‘ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা’ জানানো বক্তব্যও অনেকের কানে লেগেছে।

কিন্তু এত কিছু জেনেবুঝেও সাংবাদিক সমাজের অবস্থান ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রোজিনার ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, সাংবাদিকতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের বৃহত্তর স্বার্থে তার বিচার হতেই হবে। রোজিনা যদি কোনো সীমা লঙ্ঘন করে থাকেন, সরকার সহজেই বিষয়টি প্রেস কাউন্সিলের নজরে আনতে পারত। এখন মানবাধিকার কমিশনের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা অপরিহার্য। সাংবাদিক ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র যেকোনো মূল্যে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যারা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়, তাদেরও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে যেসব রাজনৈতিক দলের গোড়াতেই গলদ, তাদের মায়াকান্নারও আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।

ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর স্বার্থে নয়, বরং তারা কিংবা অন্য কেউ যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিষয়কে অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব সাংবাদিক সমাজ অনেক চাপ সহ্য করেও নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। ‘কোটা’ কিংবা ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো মাঠে না থাকায় ঘটনাটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে চলে যায়। আর মানুষ যখন তথ্য জানতে চায়, মূলধারার গণমাধ্যম যদি সেন্সরশিপে পড়ে যায়, তখন সবকিছুই চলে যায় গুজবের অধিকারে। এবার সাংবাদিক নেতারা প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন যেন আন্দোলনটি বেহাত হয়ে না যায়।

তবে সরকারের সংবেদনশীল অংশ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সুবিচার দাবি করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তো বলেই ফেলেছেন, এ ঘটনায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মুখে কীভাবে কালিমা লেপেছে। অবশেষে পাঁচ দিন পর রোজিনার জামিনও মিলেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রজ্ঞা ও সুবিবেচনার ওপর আস্থা রাখতেই হবে। কিন্তু এখান থেকে আমাদের সবার অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ ব্যবহার না করার অঙ্গীকার তো রক্ষিত হয়ইনি, বরং নাকের সামনে ‘তথ্য অধিকার আইন’ ও ‘হুইসিল ব্লোয়ার্স অ্যাক্ট’-এর বাতাসা ঝুলিয়ে ঝাঁপি থেকে বের করা হলো ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নামের আরেক কালসাপ। ধারালো সব আইনের খাপ খুলে রেখে শান্তিতে ঘুমানোর কোনো সুযোগ নেই! একদিকে জঙ্গিবাদের চাপাতি, আরেক দিকে যদি কালাকানুনের ছুরি গলায় ধরে রাখা হয়, তাহলে সাংবাদিকতা বাঁচে কীভাবে? আমরা যদি এসবের একটা বিহিত করতে না পারি, পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কিছুতেই ক্ষমা করবে না। আরেকটি প্রশ্নও এ সময়টায় খুব বড় করে সামনে এসেছে, সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারের দোষত্রুটি তুলে ধরতে যতটা সোচ্চার, নিজেদের ও মালিকপক্ষের অপকর্ম চেপে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ততোধিক পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে নাকি?

মোজাম্মেল বাবু : এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক