দুই-তিন দশক আগে গভর্ন্যান্সকে গভর্নমেন্টের সমার্থক শব্দ হিসেবে গণ্য করা হতো। এখন ‘গভর্নমেন্ট’কে ‘গভর্ন্যান্স’-এর একটি অংশ হিসেবে ধরা হয়, সে অংশটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বটে। আমাদের সংবিধানে ‘গভর্ন্যান্স’ শব্দটি সংবিধানের ইংরেজি পাঠে একবার মাত্র ব্যবহূত হয়েছে। তার বাংলা করা হয়েছে ‘পরিচালন’। আজকাল ‘গুড গভর্ন্যান্স’-এর বাংলা ‘সুশাসন’ করা হয়েছে। অনুবাদ খারাপ নয়, বরং অনুপ্রাসপ্রিয় বাঙালির কাছে শ্রুতিমধুর মনে হতে পারে। একসময় ‘গভর্নমেন্ট’-এর বাংলা ‘শাসন’ বেশ প্রচলিত ছিল। ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’-এর বাংলা ছিল ‘ভারত শাসন আইন’। এখন আমরা ‘গভর্নমেন্ট’-এর বাংলা ‘সরকার’ করেছি। জনপ্রিয়তার দৌড়ে ‘সুপরিচালন’-এর চেয়ে ‘সুশাসন’ শব্দটি টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
ইংরেজি ‘গভর্ন্যান্স শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘কুবেরনাও’ থেকে উদ্ধৃত। এর মানে ‘চালনা’। প্লেটো এটি রূপক অর্থে প্রথম ব্যবহার করেন। শব্দটি গ্রিক থেকে ল্যাটিনে এবং ল্যাটিন থেকে বিশ্বের বহু ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। শব্দটি প্রিজম বা ত্রিপার্শ্ব কাচের মতো বহু বর্ণের সমাহার। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কাল থেকে সরকার ও প্রশাসন পরিচালনাই গভর্ন্যাস। এর অর্থ গভর্ন্যান্স সরকার ও প্রশাসনের উভয়ের চেয়ে ব্যাপকতর। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ৮(২)-এ বলা হয়েছে, ‘এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূল সূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কার্যের ভিত্তি হইবে। তবে এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’
আফ্রিকার নিম্ন সাহারা অঞ্চলের উন্নয়ন সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে গিয়ে ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংক প্রথম গভর্ন্যান্স সম্পর্কে একটা পর্যালোচনা করে। সেই প্রতিবেদনের দলিলে সুপরিচালনকে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহি, উন্নয়নের জন্য একটি আইনি কাঠামো, তথ্য পরিবেশন ও স্বচ্ছতাকে সুপরিচালনের চারটি মূল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অপর পক্ষে সরকারি ও ব্যক্তিগত খাতের মধ্যে পার্থক্য রক্ষা করার অপারগতা, যার ফলে ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি সম্পদের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়নি, উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে পূর্বানুমানযোগ্য আইনি ব্যবস্থা ও পরিচালন প্রতিষ্ঠার অভাবে অত্যধিক নিয়ন্ত্রণবিধির দরুন বাজারের স্বাভাবিক গতিক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি, সম্পদের অপব্যবহার এবং অস্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ পদ্ধতিকে কুপরিচালন বা কুশাসনের কারণ হিসেবে সেই দলিলে শনাক্ত করা হয়।
১৯৯২ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) সুপরিচালন সম্পর্কে এই থিসিস গ্রহণ করে উন্নয়নে শরিকানা, গণতন্ত্রের ও বহুদলীয় সমাজের পরিপোষণ, স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক, সুষ্ঠু ও কার্যকর জাতীয় সরকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, স্বাধীন যোগাযোগের মাধ্যম এবং সংবাদ বিকিরণ, দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা এবং অত্যধিক সামরিক ব্যয়ের সংকোচনের কথা সুপারিশ করে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে আমি বলি, ‘আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা অতি সাম্প্রতিক কালের। অনস্বীকার্য, তার অনেকখানি পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে তার অ-আ-ক-খ আমরা কিছু আয়ত্ত করেছি। পরাধীন পরিবেশে সেই অনুশীলন ছিল খণ্ডিত, কিছুটা প্রতিবন্ধকতাদুষ্ট। পশ্চিমা সভ্যতার মোকাবিলা করতে গিয়ে আত্মমর্যাদায় তাড়িত হয়ে আমরা বলেছি, পুরাকালে আমাদের দেশেও গণতন্ত্র ও নির্বাচন ছিল। ঠিক হুবহু হবস, রুশো বা লক-এর মতো না হলেও ব্রাহ্মণ্য পুরাণে ও বৌদ্ধ জাতকে প্রায় অনুরূপ সমান চুক্তির একটা নির্দশন আমরা আবিষ্কার করার প্রয়াস পেয়েছি। পৌরাণিক তত্ত্বে দেখি, মাৎস্যন্যায়ে উত্ত্যক্ত মানুষের প্রার্থনায় দেবতারা মনুকে রাজা করে পাঠালেন। ঠিক হলো, রাজা ধর্ম রক্ষা করবেন এবং প্রজারা তাঁকে ষষ্ঠাংশ কর দেবে। বৌদ্ধ মতের সঙ্গে এ তত্ত্বের তেমন ফারাক নেই। স্বর্ণযুগের অবসানে সমাজের অবক্ষয়রোধে ‘প্রকৃতি’কুল সবাই মিলে একজনকে রাজা নির্বাচিত করল এবং তাঁর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য প্রজা এক-ষষ্ঠাংশ কর দিতে রাজি হলো। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ‘প্রকৃতি’ কর্তৃক রাজা গোপালের নির্বাচিত হওয়ার কথা প্রশস্তিকারেরা রচনা করেছেন। উভয় তত্ত্বে রাষ্ট্রের আগে সমাজ ছিল এবং রাষ্ট্রের পরও সমাজ বড় হয়ে থাকল। রাজার আসা-যাওয়ার মধ্যে সমাজ ছিল মানুষের একমত্র আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে আমাদের বাচনিক ঐতিহ্যে, বচন-প্রবচনে বাঁধনকর্ষণ ও বাধ্যকরণের যত প্রবাদবাক্যের প্রাদুর্ভাব দেখি, তাতে মনে হয় সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রশক্তিকে মাকিয়াভেলির দৃষ্টিতেই দেখে এসেছে বহুকাল ধরে। আমাদের তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সম্মুখে এখন ছোট ও বড় অনেক কাজ। বিশ্বের জ্ঞান-ভান্ডারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এখনো অত্যন্ত সীমিত।’
ওই সম্মেলনে আমি আর বলি, ‘মানবেতিহাসের বৃহদংশ, প্রায় চতুর্পঞ্চাংশ স্বৈরশাসনের ইতিহাস। স্বাভাবিকভাবে তাই, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বা শক্তিকেন্দ্রকে ঘিরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চিন্তা-ভাবনা বিবর্তিত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে, সেই অ্যারিস্টটলের যুগ থেকে। তার আগে মানুষের মনে রাষ্ট্র বিষয়ে প্রশ্ন ওঠেনি এমন নয়। তবে লেখনীরীতিতে প্রচলনের অভাবে সেই চিন্তা-চেতনার রীতিবদ্ধ রূপ গড়ে ওঠেনি।’
একটা স্বৈরশাসনের পতনের অব্যবহিত পরেই গণতন্ত্র আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে দাঁড়াবে, এমন কোনো কথা নেই। স্বৈরশাসনের অবসান বহির্দেশীয়, অভ্যন্তরীণ বা উভয়ের কারণে ঘটতে পারে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে যে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয় এবং স্বীকৃতি বিধিবদ্ধতার মধ্যে যেভাবে ক্ষমতার হস্তান্তরণ ঘটে, সেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীদের বৈধতা সম্পর্কে কোনো মৌলিক প্রশ্ন ওঠে না, নির্বাচনী উত্তেজনা থাকলেও বিস্ফোরণের আকস্মিকতা থাকে না। একটা স্বৈরশাসনের অবসানের পর হয় পুরোনো গণতান্ত্রিক কাঠামোর পুনরুদ্ধার বা সংস্কার বা একেবারে নবপর্যায়ে আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। যখন কোনো অভ্যুত্থান রাষ্ট্রমূলে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সাংবিধানিকতার ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে, তখন অনেক সময় সব কেঁচোগণ্ডূষ করে নতুন পথে হাঁটার প্রয়োজন হয়।
সমাজে রাজনীতিকরণ প্রয়োজন রয়েছে, এ ব্যাপারে তেমন মতদ্বৈধ নেই। আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন ইত্যাদি সরকারি কর্মকাণ্ড যদি প্রশাসনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এখতিয়ারে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে হাওয়া-বাতাস বন্ধ ও রুদ্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে সমাজের সর্বস্তরে যদি রাজনীতিকরণ হয় এবং রাজনীতিকরণের নামে প্রশাসনের সর্বমুখী হস্তক্ষেপ ঘটে, তখন যেসব সংস্থার স্বাস্থ্যের কারণে স্বায়ত্তশাসিত থাকা উচিত, তাদের নাভিশ্বাস উঠবে।
কোনো দেশের সরকার যতই সহস্রচক্ষু-উৎকর্ণ হোক না কেন, প্রজার সব সুখ-দুঃখের কথা তার কর্ণে প্রবেশ করবে না। রাজনীতিকেরাই প্রজাতন্ত্রের প্রজার অপরিহার্য যথার্থ প্রতিনিধি। সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধি কেবল একটি নির্বাচনকেন্দ্রের অধিবাসীদের প্রতিনিধি নন, তিনি সারা দেশের প্রতিনিধি। তিনি রাজনৈতিক দলের নিয়মকানুন মেনে তাঁর কর্তব্য পালন করলে তাঁর কর্মকাণ্ডে কোনো বাধা দেওয়া সম্পূর্ণ অবিধেয় হবে এবং গণতন্ত্র তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, অনেক দল কেবল ব্যক্তিপরিচয়ে অস্তিমান। গরচল ও অচল দলগুলো কেবল জোটের শরিক হিসেবে বেঁচে থাকে। সমাজে কেষ্টবিষ্টু হতে হবে দলে থাকা বা দল করা ভালো এমন একটা হিসাবি মন কাজ করছে মনে হয়।
আমাদের দেশে দরিদ্র দিশেহারা মানুষের কাছে রাষ্ট্র হচ্ছে বাপ-মা। মানুষ কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা ভাবে। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে যেসব মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সে লক্ষ্য আমাদের আয়ত্তের বাইরে হলেও সে আমাদের স্বপ্ন। সে স্বপ্নের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা কিন্তু বেসরকারীকরণের প্রমোদে মন ঢেলে দিয়েছি। নিছক মুনাফাকেন্দ্রিক শিক্ষায়তন, রোগ নিদান-নিরাময়কেন্দ্র ও যোগাযোগের ব্যবস্থাগুলো অনিয়ন্ত্রিত রেখে দিয়েছি। আজ দেশের কেবল্-মোবাইল-ইন্টারনেট প্রযুক্তি কাদের সুবিধার জন্য বেহিসাব স্বেচ্ছাধিকার ভোগ করছে? নিয়ন্ত্রণের ভার জটিল ও ব্যয়বহুল বলে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ আমলা তাঁর তদারকি করতে পারছেন না। সরকার তার নিয়ামকের দায়িত্ব পালনে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তা ভয়াবহ।
উপনিবেশ-বিমুক্ত প্রতিটি দেশে আজ ব্যাপক দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। দুই হাজার বছরেরও আগে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে মন্তব্য করেন, জলে চলাফেরা করার সময় মাছ জল খাচ্ছে কি না যেমন নিরূপণ করা সম্ভব নয়, সরকারে কর্মরত সরকারি কর্মচারী নিজেদের জন্য অর্থ গ্রহণ করছেন কি না, তেমনি নিরূপণ করা যায় না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি আজ সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশের প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপকতা উপনিবেশ-বিমুক্ত দেশগুলোর উন্নয়নে আজ সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আইনের জাল ছিঁড়ে বড় মাছগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে, কেবল ছোট মাছেরা কখনোসখনো ধরা পড়ছে। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বিচার করা বড়ই কঠিন। অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি দলের লোক হলে প্রভাব বিস্তারের ফলে আইনের গতি শ্লথ বা একেবারেই রুদ্ধ হয়ে যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি বিরোধী দলের হয়, তাহলে সাফাই গাওয়া হয় রাজনৈতিক হয়রানির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে।
আজকাল প্রায়ই টেকসই উন্নতির কথা শুনতে পাওয়া যায়। এই আকর্ষণীয় স্লোগানের পঞ্চাশ রকম অর্থ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। ইতিমধ্যে শব্দের ব্যঞ্জনা আরও বেড়ে থাকতে পারে। টেকসই উন্নতির উদ্দেশ্য কেবল উৎপাদন, ভোগ এবং কাঁচামালের সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান নয়, এর সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার বা ন্যায়ের যে সম্পর্ক রয়েছে, সে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ কি আমাদের জীবৎকালের দিকে লক্ষ রেখেই সীমিত থাকবে? আমাদের বংশধরদের প্রতি আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই? আমরা যেভাবে পৃথিবী ও পরিবেশকে পেয়েছিলাম, তার উন্নতি যদি করতে নাও পারি, তাহলে ঠিক সে অবস্থায় আমাদের উত্তরাধিকারীর জন্য রেখে যাওয়াই তো হবে আমাদের কর্তব্য।
যেকোনো সংঘবদ্ধতায় বা পেশায় আমরা জড়িত হই না কেন, যে পরিবেশে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, যে সমাজে আমরা বাস করি এবং যে অর্থনীতিতে আমরা জীবিকার সন্ধান করি, তাদের যথাযথ গুরুত্বদানের ব্যাপারে আমাদের সামান্য হলেও কিছু উদ্বেগ থাকা উচিত।
‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’—সংবিধানের এই কথাগুলো বলতে ভাবাবেগে আমাদের গলা বুজে আসে। কিন্তু কাজকর্মে জনগণকে আমরা কাছে ভিড়তে দিই না। জনগণকে কোনো দলই যে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না এবং বিশ্বাস করে না, তার সহজতর প্রমাণ—আজও দেশে সংবিধান প্রদর্শিত পথে স্থানীয় সরকার গঠিত হলো না।
দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিশেষ বিভাগ ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক ২০১০ সালের গণতন্ত্রের সূচকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—এই পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করে বলা হয়, পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে ২৬টি দেশে। এ ক্ষেত্রে নরওয়ের স্থান শীর্ষে। সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গণতন্ত্রচর্চায় অবনতি ঘটেছে। ৫৩টি ত্রুটিযুক্ত গণতন্ত্রের মধ্যে ভারত একটি। বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে তৃতীয় শ্রেণীতে, সংকর শাসনব্যবস্থার দেশগুলোর মধ্যে। তবে ভরসার কথা, যেখানে বহু উন্নয়নশীল দেশ গণতন্ত্রের সূচকে পিছিয়ে পড়েছে, সেখানে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে বর্তমানে ৮৩তম স্থানে আছে।
আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ ৯৩তম অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ক্ষুদ্রতর আরও ১০১টি রাষ্ট্র রয়েছে—দাবি করার সময় জনসংখ্যার বড়াই করা যায়। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশে ১৬ কোটি লোকের প্রাণাচ্ছাদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শান্তি-শৃঙ্খলার প্রয়োজন সে এক এলাহি ব্যাপার। সরকারের অদক্ষতার কথা বলে সেই বিরাট দায়িত্বকে যেমন খাটো করা যায় না, তেমনি রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হোক, ধনী বা দরিদ্র হোক সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়ন রাষ্ট্রের ওজনে যেন মাপা হয়, আজ পৃথিবীর সব দিশেহারা মানুষ সেই আশাই করে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির একাডেমিক কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তব্য
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।