সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে দিয়ে রাজনৈতিক দল ভাঙাগড়া শুরু করেছিলেন। ক্ষমতার মসনদে থেকেই তিনি গড়েছিলেন বিএনপি। আবার তিনিই একবার বলেছিলেন, ‘আই শ্যাল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ানস।’ কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে জিয়াউর রহমান এ কথা বলেননি। তিনি রাজনীতিকে সামরিক-বেসামরিক আমলা, তস্কর ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন সুবিধাবাদের গর্ভে ডুবে যাক বাংলাদেশের রাজনীতি। একই ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসক এরশাদ জাতীয় পার্টি গড়ে তোলেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে ওঠে আরও জটিল। ওই আশির দশক থেকে সামরিক শাসকদের কুমতলব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ফন্দি-ফিকির ও অপতৎপরতায় ‘রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে থাকে,’ রাজনীতি ক্রমশ পেশাদার রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ঋণখেলাপি, লুটেরা ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কাছে চলে যেতে থাকে।
এ ব্যাপারে কিছু পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ১৯৭০ সালে যাঁরা গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন ছিলেন ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি, অথচ পঞ্চম, অষ্টম ও নবম সংসদে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি কাম সাংসদের হার মোট সাংসদদের ৫০ শতাংশেরও বেশি। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আইন পেশা বা অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সাংসদ হওয়ার হার আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রথম সংসদে আইন ও অন্যান্য পেশার যেসব ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের হার ছিল মোট সাংসদের ৪২ শতাংশ, অথচ নবম অর্থাৎ বর্তমান সংসদে তাঁদের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে ‘ফুলটাইম পলিটিশিয়ানদের’! তাঁদের হার ১৩ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশ হয়েছে। ওদিকে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের নির্বাচিত হওয়ার হার বাড়ছে। ১৯৭০ সালে যাঁরা গণপরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩ শতাংশ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বর্তমান সংসদে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে (অধ্যাপক রওনক জাহান ও ড. ইনগে আমুন্দসেন, CPD-CMI Working Paper 2, THE PARLIAMENT OF BANGLADESH Representation and Accountability, এপ্রিল ২০১২।)
কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী বা পেশার মানুষের রাজনীতিতে আসতেও যেমন বাধা নেই, তেমনি সাংসদ হওয়ার ক্ষেত্রেও নেই কোনো প্রতিবন্ধকতা। তবে রাজনীতি যেন কারও স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার না হয়, সেদিকেও সবার নজর রাখা জরুরি। একসময় তাঁরাই রাজনীতিতে আসতেন, যাঁরা ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়া’তে প্রস্তুত ছিলেন। যাঁরা মানুষের সেবা করতে চান, নিজের জীবন উৎসর্গ করে হলেও দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে চান, তাঁরাই রাজনীতি করতেন। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
কয়েক দশক আগেও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণটা রাজনীতিবিদদের হাতে ছিল। ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষকসহ যেসব পেশাজীবী সাধারণ মানুষকে নানাভাবে সেবা দিতেন এবং তাঁদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন, তাঁদের অনেকেই রাজনীতিতে আসতেন। কিন্তু আজ সংসদ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৫০ জন অথবা তারও অধিক হচ্ছেন ব্যবসায়ী। রাজনীতির মধ্য দিয়ে মানুষের সেবা করা তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, কিংবা দেশ ও জনগণের স্বার্থে আইন প্রণয়নও নয় তাঁদের অগ্রাধিকার, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে সুরক্ষিত করা, উত্তরোত্তর তার উন্নয়ন ও প্রসার ঘটানো। নানা তথ্য দ্বারা আজ এটা প্রমাণিত যে ব্যবসায়ী-কাম সাংসদদের ব্যবসাটাই আসল, আর সংসদ সদস্য পদ হচ্ছে তাঁদের সাইনবোর্ড!
রাজনীতির জন্য আরও বড় বিপদের কথা হচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা বড় দুটি রাজনৈতিক দলের পলিসি মেকিংয়ে চলে এসেছেন। আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী দল, যে দলের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সারা বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে হেঁটে হেঁটে, সেই দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর পাঁচটি বছর ধরে বাংলাদেশ চালালেন আমলা উপদেষ্টারা! আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অনেক ব্যর্থতা ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ওই আমলা উপদেষ্টারা দায়ী বলে অনেকেই মনে করেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাবেক বিচারপতি ও কূটনীতিকদের নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি সমৃদ্ধ ‘থিংক ট্যাংক’ গঠন করা উচিত ছিল।
ক্যান্টনমেন্টের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এবং ব্যবসায়ী ও আমলাদের নেতৃত্বাধীন দল হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছে, কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জ্যেষ্ঠ নেতাদের যেমন আস্থায় নিতে পারেননি, তেমনি রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চায়ও স্থূলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিছুদিন আগে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে উপস্থিত সব নেতার মোবাইল ফোন জব্দ করে বৈঠকের সময় ফোনগুলো তাঁর সহকারীর কাছে জমা রাখেন। তাহলে কি তিনি তাঁর দলের নেতাদের বিশ্বাস করেন না? এ কেমন রাজনীতি, যেখানে দলের চেয়ারপারসন তাঁর নিজের দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের আস্থায় নিতে পারেন না! তাহলে কি আমরা ধরে নেব, রাজনীতি আজ লুটেরা ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী আমলাদের হাতে চলে যাওয়ায় রাজনীতিতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে?
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন নিজ নিজ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় কাউকেই বিশ্বাস করেন না অথবা ওই নেতাদের নানামুখী যোগাযোগ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সংস্থার স্বার্থরক্ষায় তৎপরতার (বা অপতৎপরতা) কারণে তাঁদের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না।
গত ২১ অক্টোবর বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেন। পরে এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন উত্থাপন করেন, এমনকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা জানান, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানতেন না। বিএনপির চেয়ারপারসন তাঁর গুলশান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তাকে নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা তৈরি করেন, যা ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং প্রস্তাবিত রূপরেখায় অনেক ভুল তথ্যও ছিল (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০১৩।) প্রিয় পাঠক, একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশের রাজনীতি কোথায় এসে উপনীত হয়েছে?
তথ্য-প্রমাণ দ্বারা আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুল সংখ্যায় লুটেরা ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী সামরিক-বেসামরিক আমলা অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেন। এখন রাজনীতি ওই লুটেরা ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী আমলাদের হাতে জিম্মি হতে চলেছে। আর বেশি দিন বোধ হয় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না, যখন আমরা দেখতে পাব যে ‘পলিটিশিয়ানস আর টোটালি আউট!’
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com