ঘোড়া তো কথা বলে না। যদি বলতে পারত, তাহলে বলত ‘বাঁচাও’! কিংবা সে হয়তো তা-ই বলছে। মানুষের মন আর কান নিয়ে আমরা তা শুনতে পাচ্ছি না! তার কোটর থেকে প্রায় বেরিয়ে আসা চোখে, ফুলে ওঠা নাকের ফুটায়, দাঁতে দাঁত চেপে থাকা ভয় পাওয়া মুখে একটাই বার্তা—বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও!
যমুনার বানের স্রোতে কেবল মাথাটা জেগে আছে। প্রাণপণ সাঁতরাচ্ছে। ডান দিক থেকে স্রোতের টান তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাঁয়ে—আরও ভাটির দিকে। যেখানে আমরা দেখে এলাম বিস্তীর্ণ জলরাশি, দেখে এলাম ভাঙনে হারিয়ে যাওয়া সাতটা গ্রাম, দেখে এলাম হাহাকারহীন নিঃশব্দ সংগ্রাম—কেউ না বাঁচালে ঘোড়াটি ভেসে যাবে সেদিকে, যেখানে মনে হয় মহাপ্লাবনে পৃথিবী পুরোটাই ডুবে আছে।
যারা পারছে, টিনের ঘর ও মাদ্রাসা, পাকা তিনতলা বিদ্যালয়—সব ভেঙে বিশাল নৌকায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসাবশেষ থেকে যা কিছু পারা যায়, কোমরপানিতে দাঁড়ানো নারী-পুরুষদের তা বাঁচানোর সংগ্রাম। শিশুদের তুলে দিয়েছে নৌকার ছইয়ের ওপর। বাকিরা করছে ভাঙা-গড়ার লড়াই।
আরও নিচে ভেসে গেলে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না—ঘোড়াটিকে। লাল মাথার ঝুঁটি-কেশরঅলা ঘোড়া। কেবল মাথাটা জাগিয়ে রেখেছে। চারপাশে পাক খাচ্ছে যমুনার ঘোলা পানি। এই যমুনা সেই যমুনা না, যা ‘দেখতে কালো, চান করিতে লাগে ভালো/ যৌবন ভাসিয়া গেল রঙ্গে’। এই ঘোলা জল ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক জীবনের সব সম্বল: ঘর-সংসার, কবুতরের খোপ, লাউয়ের জাংলা, ফসল ও ভিটা এবং জীবনের গোড়াটা বাঁধার সংগ্রাম, প্রতিবছর যে গোড়া কাঁপিয়ে দিয়ে যায় বন্যা কিংবা খরা।
আমাদের সঙ্গে ঘোড়াটার চোখাচোখি হয়ে গেল। অসহায়, ভয়ার্ত, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রায়। ভোঁস ভোঁস আওয়াজ উঠছে নাক দিয়ে। পানির তলায় তার দেহ। এর তলায় তার চার পায়ের মরিয়া সাঁতার। পানিতে সেই মরিয়াপনার আলোড়ন। মরিয়া কথাটা কেমন যেন। বাঁচার জন্য মানুষ মরিয়া হয়, মরিয়া হওয়া মানে মরার মতো তীব্র ঘটনা। ঘোড়াটার সাঁতারে সে রকম মরিয়া তীব্রতা ছিল, বাঁচার জন্য।
মাঝদরিয়ায় তাকে টেনে তোলা সম্ভব না নৌকার ওপর। একটাই উপায়—পথ দেখিয়ে তীরের কাছে নিয়ে যাওয়া। মাছ ধরার ছোট নৌকা নিয়ে সেটাই করছিল দুটি ছেলে। নদীতে ঘোড়ার ভেসে যাওয়া দেখেছিল তারা পাশেরই ছোট তারাচানপুর গ্রাম থেকে। গ্রাম বলতে পানিতে মাথা জাগিয়ে রাখা এক দ্বীপ। জায়গাটা যমুনা সেতু থেকে আরও দক্ষিণে নদীপথে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। ছোট তারাচানপুর এক চর। চরটার ওপরও কোমরসমান পানি। কোথাও কোথায় সামান্য উঁচু জমি। লোকজন সেখানটায় আশ্রয় নেয়নি। তাদের আশ্রয় উঁচু মাচা, নৌকার পাটাতন কিংবা টিনের চাল। যেটুকু উঁচু মাটি, সেটুকু তারা ছেড়ে দিয়েছে গরু-ছাগলের জন্য। এবং হ্যাঁ, ঘোড়ার জন্যও। চর এলাকায় শীতকালে যখন সব বালু আর বালু, সেই বালুতে অন্য যানবাহন চালানো যখন কঠিন, তখন ঘোড়াই প্রধান বাহন। লোকে তাই গরুর মতো যত্নে ঘোড়াও পোষে। এই ঘোড়াও হয়তো তেমনই কোনো গেরস্তের।
সিরাজগঞ্জের বন্যার্ত চরাঞ্চলে মানুষ ও পশু এখন সমান। সবারই আশ্রয় ও খাদ্যের চরম অভাব। মানুষ খাচ্ছে জমানো চাল, চালের কুমড়া। মাছ ধরা পড়লে তো ভালোই, নইলে ত্রাণের আশায় চেয়ে থাকা। কিন্তু ঘাসজমি, ধানের খড়ের পালা ডুবে যাওয়ায় গবাদিপশুর খাদ্যের দারুণ অভাব। কৃষকেরা কোথাও ডুবে ডুবে, কোথাওবা দূর থেকে নৌকায় করে চরের জেগে থাকা কাইশা ঘাস কেটে নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছে। কাইশা ঘাস পশুরা খেতে চায় না, ধারালো ঘাস, মুখ কেটে যায়। কিন্তু সেটাই এখন সম্বল। ঘোড়াটি হয়তো দূরে মাথা জাগিয়ে রাখা কাইশা ঘাসের চরে চলে যেতে চেয়েছিল। অথবা অন্যের ভিটায় আশ্রয় নেওয়ায় তারা তাড়িয়ে দিয়েছে নদীতে—সেই থেকে সাঁতরাচ্ছে। তাকে উদ্ধার করতে আসা দুই মাঝি স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না। কেবল জানাল, উজান থেকে আইছে।
ঘোড়া দুই চোখে দুই দৃশ্য দেখে, মানুষের মতো একমাত্রিক না। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সাঁতরানো ঘোড়াটির এক চোখ আমাদের ইঞ্জিন নৌকার দিকে, অন্যদিকের চোখটা সম্ভবত ওই মাঝিনৌকার দিকে। আমি শুধু দেখলাম, আমাদের দিকে তাকানো চোখটায় উৎকট ভয় আর মরিয়া আশা একসঙ্গে ফুটে আছে।
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার যমুনার চরের ঘরবাড়ি হারানো, ফসল হারানো ভাসমান মানুষের দুর্দশার প্রতীক যেন ওই লাল ঘোড়া। মানুষের মতোই শক্তিমান, কিন্তু অকূল দরিয়ায় ভাসমান।
আমরা যখন চলে আসছি, ঘোড়াটিকে তখন তীরের কাছে নেওয়া হয়েছে। তীরে এসে তরি না ডুবলে তার বাঁচার কথা। যদি বাঁচেও, তাহলে পরের প্রশ্ন, খাবে কী? আর যদি খেতেও পায়, তাহলেও আশঙ্কা—২১-২২ তারিখের অমাবস্যার সময় আবার যখন পানি বাড়বে, তখন দাঁড়ানোর জায়গাও তারা পাবে কি? যে দুই তরুণ তাকে বাঁচাল, তাদের মতো মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে চরের গরু-ছাগল ও ঘোড়াদের ভাগ্য একই সুতাই বাঁধা। দুর্যোগের টানে সুতাটি ছিঁড়ে যেতে বসেছে। তার আগেই, সরকার কি শুনতে পাও তাদের এসওএস বার্তা—সেইভ আওয়ার সৌলস!