নির্বাচনের মাত্র ৩৫ দিন আগে যখন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন প্রথম বিতর্কে পরস্পরের মুখোমুখি হবেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রেই কয়েক কোটি মানুষ তা দেখতে টেলিভিশনের সামনে উপস্থিত থাকবেন। দেশের বাইরেও যে লক্ষ লক্ষ মানুষ তা দেখবেন, তা-ও বলা যায়। অন্যান্য মাধ্যমেও দর্শকের কমতি হবে না। এ বিতর্ক হবে যুক্তরাষ্ট্র সময় মঙ্গলবার রাতে (বাংলাদেশ সময় বুধবার সকালে)। কিন্তু এ বিতর্ক ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কি না, কী ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং সেটা কার জন্য অনুকূল হবে—সেটাই প্রশ্ন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বিতর্ক, বিশেষ করে প্রথম বিতর্ক, একটা বড় ধরনের টেলিভিশন ইভেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের মধ্যকার প্রথম বিতর্কের দর্শক ছিল ৮ কোটি ৪০ লাখ। ১৯৬০ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে যতগুলো টেলিভিশন বিতর্ক হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শক হয়েছিল ২০১৬ সালের এই বিতর্কে। এ বছর এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। তার কারণ একাধিক। করোনাভাইরাসের কারণে ভোটাররা অন্য সময়ে প্রার্থীদের যতটা দেখতে ও শুনতে পারেন, এ বছর তা হয়নি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটেছে আগের চেয়ে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
এ বিতর্ক নিয়ে দেশের গণমাধ্যম, দুই দলের নির্বাচনী কৌশলবিদ এবং কট্টর সমর্থকদের মধ্যে আগ্রহ ও উত্তেজনা থাকলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা সব সময়ই বলে এসেছেন যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বিতর্ক আসলে ভোটারদের মন বদলাতে পারে না। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় গবেষণা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক ভিনসেন্ট পন্স এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের পিএইচডি শিক্ষার্থী ক্যারোলাইন লা পেনেক-কেলদোচৌরি। তাঁরা ১৯৫২ সাল থেকে ৯টি দেশের ৬১টি নির্বাচনে ভোটাররা কখন প্রার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁদের ওপর টেলিভিশন বিতর্ক কতটা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন। নির্বাচনের আগে ও পরে ১ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের ওপর করা সব জরিপ তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন, এর ৮০ শতাংশ বিতর্ক দেখেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণার ফলাফল হচ্ছে, বিতর্ক নির্বাচনের ফলাফলে কোনো প্রভাব রাখেনি। এমনকি বয়সে তরুণ এবং যাঁরা নির্বাচন বিষয়ে কম খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের পছন্দ বদলাতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক বড়সংখ্যক গবেষক একই ধরনের উপসংহারে পৌঁছেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস স্টিমসন তাঁর ‘টাইডস অফ কনসেন্ট’ গ্রন্থে বলেন, ১৯৬০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে কোনো বিতর্ক কোনো প্রার্থীর ভাগ্য বদলাতে পারেনি। যাকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলা হয়, এমন কোনো বিতর্ক হয়নি। তবে তিনি লিখেছেন, বড়জোর খুব সামান্য কিছু এদিক-সেদিক করেছে। রবার্ট এরিকসন ও ক্রিস্টোফার ওয়েলজিন ‘দ্য টাইম লাইন অব প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন’ গ্রন্থে ১৯৫২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচনের বিশ্লেষণে বলেছেন, ১৯৭৬ সালের নির্বাচন ছাড়া আর কখনোই বিতর্ক প্রভাব ফেলেনি। তার মানে হচ্ছে বিতর্কের আগে যে অবস্থা থাকে, বিতর্কের পরও তা বদলায় না। কোনো গবেষক মনে করেন যে বিতর্ক একেবারেই প্রভাবহীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থমাস হলব্রুক মনে করেন, বিতর্ক, বিশেষ করে প্রথম বিতর্ক, ভোটারদের প্রার্থীদের জানার জন্য সাহায্য করে। নেট সিলভার, যার পরিচিত হচ্ছে নির্বাচনের ভবিষ্যদ্বাণী আর হিসাব-নিকেশের গুরু হিসেবে, ২০১২ সালে তিনি দেখিয়েছিলেন যে অতীতে প্রথম বিতর্কের পর ক্ষমতাসীনের চেয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের জাতীয় জনমত জরিপে ভালো করার ইতিহাস আছে।
বিতর্ক প্রভাব ফেলে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মার্কিন নাগরিকেরা টেলিভিশন ইভেন্ট হিসেবে হলেও বিতর্ক দেখতে চান, সেটা অনস্বীকার্য। প্রভাব বিস্তার না করতে পারার অতীতের ধারাবাহিকতা এবারও থাকবে নাকি ভিন্ন রকম কিছু দেখা যাবে, সেটা আমরা পরে জানতে পারব। তবে যদি এই বিতর্কে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে, তবে তা জো বাইডেনের জন্য সুসংবাদই হবে। কেননা এখন পর্যন্ত জাতীয় জনমত জরিপে তিনি এগিয়ে এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজ্যগুলোর অধিকাংশেই তিনি হয় এগিয়ে আছেন, নতুবা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে।
এটাও সহজেই অনুমেয় যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্ক করা জো বাইডেনের সহজ হবে না। কারণ, ট্রাম্প বিতর্কে প্রশ্নে যে বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে থাকতে অনাগ্রহী, তদুপরি তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণে মোটেই পিছপা হন না। ২০১৬ সালে দলের প্রাইমারির এবং ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বিতর্কে দেখা গেছে যে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের বক্তব্যের মাঝখানেই এক বাক্যের আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে থাকেন। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা কমবেশি একমত যে বিতর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যথেষ্ট পরিমাণে ভুল তথ্য ও মিথ্যাচার করবেন।
বাইডেনের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তিনি কী কৌশল নেবেন। তিনি কি ট্রাম্পের এসব মিথ্যাচার, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং তাঁর বক্তব্যে বাধা দেওয়ার ঘটনাগুলো মোকাবিলা করবেন নাকি এসবের বাইরে থেকে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির কৌশলবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, এগুলো মোকাবিলা না করলে বাইডেনকে দুর্বল বলে মনে হবে। আবার অন্যরা মনে করেন, বাইডেনের উচিত হবে স্থিরতা দেখানো, দেশের অবস্থা বোঝানো এবং ভোটারদেরই এ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা যে এই সংকটকালে তাঁর মতো স্থির নেতৃত্বই দরকার।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর