মানুষ মানুষের জন্য

নবতর কর্মসূচি ‘ফ্রেন্ডশিপ হাউস’-এর তিনটি প্যাভিলিয়নে শোভা পাচ্ছে ১০৪টি স্টল। যেকোনো একটিতে সময় দিলেই মন ভরে যাবে। বৃদ্ধদের সমস্যা ভুলে যাওয়া, কীভাবে এই ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর আলঝেইমার রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তার জন্য প্রজেক্ট, পানিতে বিষ অর্থাৎ আর্সেনিক অথবা পানির অভাব, তাদের জন্য অসংখ্য প্রজেক্ট; পোলিও, মাতৃত্ব, শিক্ষাসংক্রান্ত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য নানা সাহায্যের ডালি নিয়ে প্রস্তুত বিশ্বের ১৮ হাজার ক্লাব।

এবার সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ‘শান্তি’ নিয়ে। থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিওর আন্তর্জাতিক ক্রিস্টিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমনি আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১০ জন স্কলার কয়েক বছর ধরে ব্যাপৃত কীভাবে পৃথিবীতে আনা যায় শান্তির অনাবিল স্পর্শ। আমেরিকায় সাত হাজার ৭৯৭টি ক্লাব, তিন লাখ ৪০ হাজার সদস্য। জাপানে দুই হাজার ২৮৫টি ক্লাব, ৮৮ হাজার ১৭৪ সদস্য। ভারতে তিন হাজার ১৭৩টি ক্লাব, সদস্য এক লাখ ২০ হাজার ৪৫৬। সর্বমোট রোটারিয়ান ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। খরচ হয়েছে এযাবৎ ২০৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ক্লাবের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমরা গিয়েছি ৪০০ জন।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাকুজি তানাকা ও আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট রন বার্টন তাঁদের অন্তরের মানবতার প্রতি টান প্রকাশ করলেন। আমার মতে, সবচেয়ে ভালো বক্তা ছিলেন স্মার্ট জেনারেল সেক্রেটারি জন হিউকো। তিনি জানালেন, রোটারি কীভাবে ‘ফিউচার ভিশন’-এ প্রতিটি মানুষের
কল্যাণে দিতে পারবে সময়, যে সময়টুকুতে শুধু পোলিও নয়, নিরাশার মধ্যেও আশার মতো জ্বলে থাকবে রোটারির প্রত্যয়। কয়েক দিন আগে সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিলেন। এত ভিড়েও কাছে টানলেন, বললেন, ‘বাংলাদেশে এসে বুঝতে পেরেছি, তোমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

যাঁদের বক্তৃতা মন ছুঁয়ে যেতেই হবে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী লেইমা বুয়ি। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে জানালেন, মেয়েদের নিরাপত্তার কথা সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে। কারণ, তারা নিরাপদ না হলে জগতে শান্তি আসবে না। বক্তৃতার মাঝে মাঝে সমবেত ২৫ হাজার রোটারিয়ান তিনবার উঠে দাঁড়ালেন করতালির মাধ্যমে। ভারতের অভিনেত্রী আর্চি পাঞ্জাবি অভিনয়ে পেয়েছেন ‘অ্যামি অ্যাওয়ার্ড’ এবং সেই সঙ্গে নারীর প্রতি দুর্বিনীত ব্যবহারের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সারা পৃথিবীতে পোলিওর শেষ ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে তিনি নিয়েছেন হ্যামিলনের ভূমিকা। নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কে গত বছরের সেপ্টেম্বরে অবিস্মরণীয় ‘দিস ক্লোজ’ ক্যাম্পেইনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে শুনলাম ড. জেন গুডল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ড. জেন গুডলের বক্তৃতা, যিনি লাভ করেছেন বহু পুরস্কার। এখানে এসে যাঁরা জেন ও ক্রেগ কিল বার্গার, সেলিন কসতো, ইমানুয়েল জালের বক্তৃতা শোনেননি, বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা শ্রেষ্ঠ বক্তাদের আন্তরিক ও সারা জীবন মনে রাখার মতো বক্তৃতাগুলো।

জীবনের অনেক বসন্ত কাটিয়েছি রোটারির সঙ্গে, প্রেসিডেন্ট, গভর্নর, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের  প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে নানা দেশ সফর করে। হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা ভিন্ন ভাষায় কথা বলি, ভিন্নভাবে চিন্তা করি, তাঁরা কীভাবে একটি আয়োজনে একত্র হলাম, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। পর্তুগালের পুরো শহরটি যেন রোটারির সংগীতের তালে তালে এক নতুন রূপে সেজেছে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞরা এসেছেন তাঁদের কণ্ঠ, যন্ত্র ও নৃত্য পদসঞ্চালন নিয়ে। আর সেই সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক ফুড কোর্টে’ নানা দেশের খাবার। বাঙালিরা খোঁজে ডাল-ভাত। সে ক্ষুধা মেটালেন বাঙালিপাড়ার বাঙালিরা। লিসবনে রয়েছেন ২৫ হাজার বাঙালি।

সংগীত কাছে টানে। চারজন শিল্পী চার দেশের—সুইস টেনার উর্স বুলার, স্পেনের ব্যারিটন কার্লো মারিন, ফরাসি পপশিল্পী সেভাসটিয়ান ইজামবার্ড ও আমেরিকার টেনার ডেভিড মিলার মিলে পরিবেশন করলেন ‘ডিভো’; সৃষ্ট হলো জাদু। অ্যালবাম বিক্রির সংখ্যা ২৬ মিলিয়ন, ১৬০টি গোল্ড ও প্লাটিনাম ডিস্ক এবং দুই মিলিয়ন কনসার্ট বিক্রির ইতিহাস, ক্লাসিক্যাল অ্যালবাম ‘অ্যাংকোরা’ অদ্যাবধি অপরাজেয়। ডিভোর যাত্রা শুরু ২০০৩, নয় বছরেও অপরাজেয়। লিসবনের ‘অর্কেস্ট্রা মেট্রোপলিটনা’ ওএমএল জগদ্বিখ্যাত। ফার্নান্ডো ভ্যারেলা ‘বর্ন টু সিং’ প্রতিযোগিতার বিজয়ী, এমন গান কমই শুনেছি। মাইকেল জ্যাকসনের ধরনে ভ্যারেলার টেনোর সুরবিন্যাস ও তারপর শ্রোতাদের মন কেড়ে নিলেন দুজন তরুণ ক্রোয়েশিয়ান চেলো শিল্পী। তাঁদের বাজনা না শুনলে বোঝাই যাবে না, চেলো কাকে বলে। শ্রোতা নিয়ে টানাটানি। তানাকা বলছেন, ‘আমার বক্তৃতা শুনতে এসো,’ ওদিকে নতুন প্রেসিডেন্ট রন বার্টনের আহ্বান। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি। পুরোনো বন্ধু রাজা সাবু, কল্যাণ ব্যানার্জিদের মতো বক্তা পৃথিবীতে বিরল। এর সঙ্গে রে ক্লিঙ্গিংস্মিথ, শ্যামুয়েল ওয়ারির সঙ্গে ডিনার খেলাম।

শেষ দিনের শেষ গান: ‘কনসার্ট ফর পিস’। ফার্নান্ডো ভ্যারেলা, হেলে ওয়েস্টার্নরা, দুই চেলো, সেন্ট ডমিনিকস গসপেল কয়ার গাইলেন ও বাজালেন পৃথিবীতে শান্তির জন্য মধুর সংগীত।

সাকুজি তানাকা বললেন, ‘ছিলাম গরিবের ছেলে, জায়গির থেকে বড় হয়েছি, তাদের ব্যবসাকে বড় করে জগতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। দেশে দেশে গিয়ে মানুষের সেবা করেছি, এমনকি বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও। বড় হতে চেয়েছি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে। আজ আমার রাজার সম্মান, পেলাম মানুষের প্রতি ভালোবাসার জন্য।’

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।

mabbasi@dhaka.net