লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টির মধ্যে ৩৪টি আসন জিতেও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে হাসি ফোটেনি। শুক্রবার ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে মমতা যখন সাংবাদিকদের সামনে হাজির হন, তখন প্রত্যাশিতভাবেই তিনি এই জয়কে ‘যাবতীয় অপপ্রচার, কুৎসা ও রটনা’র বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জবাব বলে অভিহিত করেন। কিন্তু মমতার কথায় কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না, এমনকি তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেও রাজি নন বলে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে মমতাকে তঁার রাজনৈতিক জীবনে জয়-পরাজয়ের বিভিন্ন নাটকীয় মুহূর্তে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে প্রথমেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভোটের এই ফল সত্ত্বেও মমতা খুশি নন। বরং এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ভোটের ফল মমতাকে বেশ চিন্তায় ফেলেছে।
এটা ঠিক যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে ১৯৫২ সাল থেকেই অংশ নিতে শুরু করার পরে বামপন্থীরা এবারই সবচেয়ে খারাপ ফল করল। ত্রিপুরা ও কেরালায় কিছুটা মুখ রক্ষা করতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গে এবার বামপন্থীরা প্রায় মুছে যাওয়ার উপক্রম।
মমতার ঘোষিত শত্রু বামেরা পশ্চিমবঙ্গে মমতার দলের কাছে এভাবে লেজেগোবরে হবে, তা অনেকের কাছেই স্বপ্নেরও অতীত ছিল। তা সত্ত্বেও এই বিপুল জয় মমতার মুখে হাসি ফোটাতে পারল না, কারণ পশ্চিমবঙ্গে এবারই বিরাটভাবে উপস্থিত হয়েছে বিজেপি। এ রাজ্যে মাত্র দুটি আসন পেলেও বিজেপির এই জয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, বিজেপি একার শক্তিতে লড়ে শুধু দুটি আসন জিতল, তা-ই নয়, মমতার চ্যালেঞ্জকে উড়িয়ে দিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থন নিয়ে দার্জিলিং কেন্দ্রটি জিতে বুঝিয়ে দিল, পাহাড়ে অচিরেই আবারও পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের আন্দোলন মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মাথা তুলবে।
কিন্তু মমতার উদ্বেগের আসল কারণ এটা নয়। এবারের ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি দুটি আসন জেতা ছাড়াও তিনটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে এবং ছয়টি আসনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া, বাকি ৩১টি আসনে কংগ্রেসকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেসকে এ রাজ্যে অনেক পেছনে ফেলার সঙ্গেই এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে, বামপন্থীদের দুর্বল হওয়ার কারণে তাদের ভোটও বিজেপির দিকে সরছে। ভোটের বিচারে খোদ কলকাতায় দুটি কেন্দ্রেই বিজেপি শুধু বামপন্থী ও কংগ্রেসকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানেই উঠে আসেনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের বিধানসভা আসনসহ বহু তাবড় তাবড় তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীর কেন্দ্রে শাসক তৃণমূলকে পেছনে ফেলেছে। গোটা রাজ্যে এভাবে
বিজেপির বিস্ময়কর উত্থানের সঙ্গেই সমহারে বামপন্থীদের দুর্বল হয়ে পড়ার মধ্যে অবশ্যই একটা গভীর কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে।
ভোটের পরে একাধিক বাম নেতাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে তঁাদের দুর্বলতার কারণে রাজ্যের অসংখ্য গরিব মানুষ বাধ্য হয়েই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বামপন্থী চিন্তাবিদ রতন খাসনবিশ বলেন, বামপন্থীদের থেকে ভোট সরে যাচ্ছে, কারণ শক্তিশালী দল হিসেবে সিপিএমের যে ভাবমূর্তি ছিল, তা আর অবশিষ্ট নেই। গরিবেরা নির্ভর করবে কী করে? আবার বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য রীতেশ তেওয়ারি বলেন, গত আড়াই বছর তৃণমূল সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দল হিসেবে যে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, সেটা সিপিএম করেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ৩৯ শতাংশ ভোটের হারের দিকে ইঙ্গিত করে রীতেশের বক্তব্য, অঙ্কেই স্পষ্ট, তৃণমূল যতই বেশি আসনে জিতুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের শাসনে অসন্তুষ্ট।
গণতান্ত্রিক পরিসরে যেহেতু সরকারের বা শাসক দলের কাজকর্মের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বা প্রতিবাদ প্রকাশের জন্য সাধারণ মানুষ বিরোধী দলের ওপরই নির্ভর করে থাকে, তাই বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে কতটা সক্রিয়তা দেখাতে পারে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে তীব্র গণবিক্ষোভের মুখে সিপিএম তথা বামপন্থীরা ক্ষমতাচ্যুত হয়, এবং তার ধাক্কায় তারা এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে যায় যে দলের বহু কর্মী-সমর্থক দল ছাড়েন। নেতারা এতটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েন যে বামপন্থীদের চিরাচরিত ট্রেডমার্ক রাস্তায় নেমে রাজনৈতিক আন্দোলনও করা বন্ধ হয়ে যায়। প্রধানত সংবাদমাধ্যমের কাছে বিবৃতি দিয়েই তারা দায়িত্ব সারতে থাকে। ফলে, সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি, স্কুলশিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কেলেঙ্কারি, একের পর এক ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহ, স্কুলে-কলেজে শাসক দলের কর্মীদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ও গুন্ডাগিরি—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ করতে চাইলেও বামপন্থীরা সেই প্রতিবাদের ভাষা জোগাতে পারেনি। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছিল যে এখানে তৃণমূলের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক দলেরই নেই। নির্বাচনী প্রচারে এসে
নরেন্দ্র মোদি যখন সরাসরি মমতাকেই এসব বিষয়ের কথা বলে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন, তখন তা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে বিরাট সাড়া ফেলল৷ মানুষ বুঝতে পারলেন, এ রাজ্যে মমতাকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, তা বামপন্থীরা নয়, বিজেপি। আর সেই ধারণা থেকেই বিজেপির এত দ্রুত প্রভাব বৃদ্ধি।
লোকসভা ভোটের খুঁটিনাটি বিচার করলে বোঝা যাবে, বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৩০টির বেশি বিধানসভা আসনে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসের চেয়ে এগিয়ে আছে। এবার লোকসভা ভোটে ৪২টি আসনের সব কটিতেই প্রার্থী দঁাড় করালেও সংগঠনের অভাবে অনেক জায়গাতেই বুথে এজেন্ট বসাতে পারেনি। ফলে, যতটা ভোট পেতে পারত, তার পুরোটা পায়নি। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোট। মাঝের দুই বছরে বিজেপি সাংগঠনিকভাবেও রাজ্যে নিজেদের যথেষ্ট গুছিয়ে নিতে পারবে। মোদির নেতৃত্বে দেশজুড়ে জয়ের হাওয়ায় এবার পশ্চিমবঙ্গেও মানুষ দলের চারপাশে বেশি করে ভিড় করবে। কোনো সন্দেহ নেই। বিজেপির শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই যে তাল রেখে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে প্রতিফলিত করে বিজেপি রাস্তার আন্দোলনে নেমে চাপ সৃষ্টি করবে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। ২০১৬ সালে বিজেপি এ রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝঁাপাবে। বাড়তি শক্তি ও উদ্দীপনা অন্যদিকে, দিল্লিতে নিজেদের সরকার থাকার ফলে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনও বিধানসভা ভোটের সময় চাপে থাকবে। সব মিলিয়ে মমতার দুশ্চিন্তার কারণ যথেষ্ট রয়েছে।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।