ভারতের নির্বাচন

মমতার গোয়েবলসকে অনুসরণ?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকেই এটা বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন যে একটা মিথ্যাকে বারবার সোচ্চারে বললেই সেটা সত্যি হয়ে যায়। প্রচারের এই গোয়েবলসীয় কায়দা রাজনীতিকদের প্রায়ই অনুসরণ করতে দেখা যায়, যেমনটি এবার তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন।
দুদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে মালদহে গিয়ে সেখানেই একটি হোটেলে রাত কাটান। রাতে তাঁর ঘরের এসি মেশিন থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে মমতা লোকজন ডাকলে দমকল বাহিনীর লোকজন এসি মেশিনের আগুন নিভিয়ে দেন। মমতা সেই হোটেলেই অন্য ঘরে রাতে ঘুমান। পুলিশ তদন্ত করে জানায়, সম্ভবত এসি মেশিনের বৈদ্যুতিক সংযোগে ‘শর্টসার্কিট’ হয়েছিল। পরদিন বীরভূমে নলহাটির জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মমতা অভিযোগ করে বসেন, তাঁকে নাকি প্রাণে মারার চক্রান্ত হচ্ছিল। তাঁর অভিযোগের তির যে সিপিএমের দিকে, সেটাও খোলাখুলিই বলেন।
এর পরই বীরভূমের সিউড়িতে মমতাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে পৌঁছানোর ঘণ্টা খানেক আগে জানা যায়, সভাস্থলের ছয় কিলোমিটার দূরে রাস্তার কালভার্টের তলায় নাকি বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে সভায় আসার সময় তৃণমূল-সমর্থকেরাই ওই বিস্ফোরক দেখতে পান। পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল সেখানে পৌঁছালেও তৃণমূলের কর্মীরাই কালভার্টের তলা থেকে বেরিয়ে থাকা ইলেকট্রিক তার টেনে একটি প্লাস্টিকের মোড়ক বের করেন। তাঁরা সেই মোড়ক নিজেরাই খুলে পুলিশকে দেখান, তার মধ্যে দুটি জিলেটিন স্টিক ও দুটি ডেটোনেটর আছে। একটু পরেই সেই রাস্তা দিয়ে স্থানীয় সিপিএমের কর্মী শেখ হীরালাল মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন, তাঁকে তৃণমূলের কর্মীরা নামিয়ে প্রচণ্ড পেটান। পরে তিনি মারা যান।
সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের পাতা ল্যান্ডমাইনকে দায়সারাভাবে নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বম্ব স্কোয়াডের লোকজন মারা গিয়েছেন। তা সত্ত্বেও যেভাবে তৃণমূলের কর্মীরা তড়িঘড়ি কালভার্টের তলা থেকে বিস্ফোরক বের করে এনে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন, তাতে মনে হতেই পারে যে ওই বিস্ফোরক যে নিষ্ক্রিয় ছিল, সেটা তাঁরা জানতেন। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও তাই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যেভাবে তাঁরা নিজেরাই বিস্ফোরক উদ্ধার করে মোড়ক খুলেছেন, তাতে মনে হয়, তাঁরাই এসব রেখে সিপিএমকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বামপন্থী নেতারা এটাও বলছেন যে মালদহের এসিবিভ্রাটের ঘটনাকে বীরভূমে গিয়ে তাঁকে প্রাণে মারার চক্রান্ত বলে দলীয় কর্মীদের প্ররোচনা দিয়েছিলেন সিপিএমের ওপর আক্রমণ করতে; শেখ হীরালালের মৃত্যু তারই পরিণতি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর একটি গুণ, তিনি ভুলে যান কদিন আগে কী বলেছিলেন। গত বছর সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হলো এবং এই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথাও উঠতে শুরু করল, তখন এক জনসভায় মমতা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললেন, ‘আমরা চোর? কুণাল (ঘোষ) চোর? মুকুল (রায়) চোর? মদন (মিত্র) চোর?’ তার কয় মাস পরে রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য কুণালকে তাঁরই পুলিশ সারদাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। তিনি আর সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। এবার কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ইডি) ওই সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত বলে তৃণমূল নেতাদের জেরা করতে চলেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই মমতা আবার এ নিয়ে মুখ খুললেন। নির্বাচনী জনসভায় তিনি দাবি করলেন, তিনি বা দলের কেউই চিট ফান্ডের টাকা নেননি; বরং তাঁর পাল্টা দাবি, ওসব সিপিএম আমলে হতো, সিপিএম চিট ফান্ড থেকে টাকা নিত।
মুশকিল হলো, সারদাকাণ্ডে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করার দাবি কিন্তু এই বামপন্থীরাই করে আসছে। আর যে মমতা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন ছোট-বড় সবকিছুর তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হতেন, এখন তাঁর সরকারই প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে সিবিআইকে ঠেকাতে। দেখে-শুনে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ছিলেন সততার প্রতীক, হয়েছেন সারদার প্রতীক।
বিজেপি সম্পর্কেও ভোটের আগের কয় মাস মমতার অবস্থান জানা যায়নি। যিনি দুনিয়ার সব বিষয়েই মন্তব্য করতে ছাড়েন না, তিনি গুজরাট দাঙ্গার অপরাধে কলঙ্কিত নরেন্দ্র মোদির জাতীয় রাজনীতিতে উত্থান এবং বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া নিয়ে বিস্ময়কর নীরবতা পালন করে চলেন। কিন্তু ভোটের প্রচারে নেমে যতই বুঝতে পারছেন যে বিজেপি তাঁদের ভোটেও ভাগ বসাতে চলেছে, তখনই তিনি বিজেপি-বিরোধিতায় সরব হতে শুরু করলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মমতার মুখে গুজরাট দাঙ্গার দায়ে নরেন্দ্র মোদির নিন্দা শোনা যায়নি। রাজনৈতিক মহলে প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে যে ভোটের পরের অবস্থায় প্রয়োজনে বিজেপির সঙ্গেও দর-কষাকষির রাস্তা মমতা খোলা রাখতে আগ্রহী।
বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাস্তববাদী। তাঁরা মনে করেন, বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গড়ার অবস্থায় পৌঁছালেও মমতার দল আগের মতো এনডিএ জোটের শরিক হয়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই সংখ্যালঘু মুসলমান। তাঁরা অনেকেই মমতাকে এখন সমর্থন করছেন বটে, কিন্তু বিজেপির সঙ্গে মাখামাখি তাঁরা ভালোভাবে নেবেন না। সামনেই ২০১৬ সালে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোট লড়তে হবে। ফলে, মমতা এখন বিজেপিকে সরকার গড়তে সমর্থন করলেও বিধানসভা ভোটের এক বছর আগেই (অর্থাৎ, ২০১৫ সালেই) কোনো একটা অজুহাতে সমর্থন প্রত্যাহার করে মুসলমানদের মন পেতে আবার বিজেপি-বিরোধিতা তীব্র করবেন। তাই বিজেপি এখন মমতাকে সঙ্গে পেতে আর আগের মতো ব্যাকুলতা দেখাচ্ছে না।
কিন্তু মমতা কি সত্যিই আবারও বিজেপির হাত ধরবেন? এ ব্যাপারে তাঁর দলের সঙ্গীরাও কেউই জোর করে কিছু বলতে পারছেন না। কারণ, মমতার দলে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক একা মমতাই। আর তিনি যে সাময়িক সুবিধার জন্য নীতিগত অবস্থান থেকে অনায়াসে সরে আসতে পারেন, তার প্রমাণ ছিটমহল নিয়ে ভোটের মুখে তাঁর সুর বদল করা। এবার ভোটের ঠিক তিন দিন আগে কোচবিহারে গিয়ে মমতা জনসভায় নিজেই ছিটমহল প্রসঙ্গ তুলে বললেন, এ ব্যাপারে সেখানকার মানুষ যা ঠিক করবেন, সেটাই হবে। এত দিন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হতে না দিয়ে যেমন তিনি বাধা দিয়ে এসেছেন, তেমনই বাধা দিয়ে চলেছেন ছিটমহল হস্তান্তর নিয়েও। কিন্তু ভোট বড় বালাই, তাই সুর বদলাতে মমতার অসুবিধা হলো না। আবার ভোট মিটে গেলে যে এ নিয়ে তিনি আর ছিটমহল প্রসঙ্গ তুলবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
মমতার রাজনীতিটাই এ রকম তাৎক্ষণিক সুবিধাপ্রাপ্তির সংকীর্ণ লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে তৈরি।

রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।