প্রায় ৪০ বছর অপেক্ষার পরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় এবার চূড়ান্ত পরিণতি পাবে বলে আশা করা গিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এ নিয়ে চুক্তির পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ওই চুক্তি অনুমোদন করলেও ভারতের তরফ থেকে অগ্রগতি না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলেই থাকে। দীর্ঘদিন পরে ভারতের তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়ায় বিষয়টির মীমাংসা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাতেও বাধা দিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তূণমূল কংগ্রেস সরকার। কদিন আগেই সংসদে কেন্দ্রীয় সরকার এই মর্মে এক বিল আনার চেষ্টা করলে তূণমূল কংগ্রেসের সাংসদেরা তাতে বাধা দেন। তাঁদের বক্তব্য, ছিটমহল বিনিময় হলে ভারত অনেক জমি হারাবে, সেই সঙ্গে অনেক বাড়তি মানুষের বোঝা চাপবে তার ওপর। আর পুরোটাই আসবে পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে। অথচ ২০১১ সালের মে মাসে নির্বাচনে জিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাস পরেই রাজ্য সরকারের তরফে মুখ্যসচিব লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে ছিটমহল বিনিময়ে তাদের সায় জানিয়ে দেন। কিন্তু এখন তূণমূল কংগ্রেস বলছে, ওই অবস্থান আগের বামফ্রন্ট সরকার নিয়েছিল। সেটাই পরে মুখ্যসচিব দিল্লিতে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তাদের সায় নেই।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার পরিচালনায় যে একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখার নীতি, তূণমূল কংগ্রেসের সরকার সেসব নিয়ে আদৌ বিচলিত বলে মনে হয় না। এর আগে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে বাধা দেন। এবার ছিটমহল নিয়েও একই চেষ্টা চলছে। যেহেতু ইউপিএ সরকারের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বাধা দিতে তেমন সক্রিয় নয়, তাই ধরে নেওয়া যায় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত প্রস্তাব সংসদের অনুমোদন পেয়ে যাবে। যেমন, কয়েক দিন আগেই জমি বিল, পেনশন বিল ও খাদ্যনিরাপত্তা বিল অনুমোদন পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের এই নতুন করে আপত্তি কেন, তা দেখার আগে একবার ছিটমহল সমস্যার সম্যক চিত্রটি দেখা দরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মোট ১৬২টি ছিটমহলকে নিয়ে এই বিতর্ক। এর মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিটমহল রয়েছে ১১১টি আর ভারতের (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের) মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহল রয়েছে ৫১টি। এ বছরের ২৩ এপ্রিল সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম রামচন্দ্রন জানিয়েছেন, ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে মোট ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন মানুষ বাস করছে। আর বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারীর সংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫। জমির হিসাবে ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহলের মোট আয়তন প্রায় সাত হাজার একর আর বাংলাদেশের মধ্যে ভারতীয় ছিটমহলের মোট আয়তন ১৭ হাজার একর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই ছিটমহলগুলো বিনিময়ের জন্য যে প্রাথমিক বোঝাপড়া রয়েছে, তাতে ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারা কোন দেশের নাগরিকত্ব চায়। অর্থাৎ ছিটমহল বিনিময় হয়ে গেলে দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের যাতে নতুন করে ভিটেমাটি ছেড়ে আবার উদ্বাস্তু না হতে হয়, সে জন্য বাংলাদেশের অন্তর্গত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা নিজেরাই ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিজেদের এত দিনের জমি-বাড়িতে থেকে যেতে পারবে। একই ভাবে, ভারতের মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারাও চাইলে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই থেকে যেতে পারবে।
বলা হচ্ছে, ছিটমহল বিনিময় হলে পশ্চিমবঙ্গের লোকসান হবে বিপুল। জমি হারাবে, আবার জনসংখ্যার বাড়তি বোঝা চাপবে। এটা ঠিক, বাংলাদেশের মধ্যে ভারতীয় ছিটমহল যা আছে, সবই পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের সব ছিটমহলই কোচবিহার জেলার মধ্যে। যেহেতু বাংলাদেশের ছিটমহলের আয়তন ভারতীয় ছিটমহলের মোট আয়তনের চেয়ে ১০ হাজার একর বেশি এবং লোকসংখ্যাও সামান্য বেশি (১৩ হাজার), তাই বিনিময় হলে পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা জমি হারাবে এবং সেই সঙ্গে জনসংখ্যা সামান্য হলেও বাড়তে পারে। কিন্তু এই যুক্তিতে ছিটমহল বিনিময় আটকে রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত?
দুভাবে এই বিষয়টিকে দেখা যায়। প্রথমত, জমি হারানোর প্রশ্নটি। সরল পাটিগণিতের হিসাবে এটা ঠিকই, ভারত ১০ হাজার একর জমি হারাবে। কিন্তু বাস্তবে কি তা-ই? এই ১৭ হাজার একর জমি তো এখনো (৬৬ বছর ধরেই) ভারতের হাতে নেই। বরং যেটা হবে, তা হলো কোচবিহারের অন্তর্গত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর সাত হাজার একর জমি ভারতের হাতে আসবে। পূর্ব বাংলায় ফেলে আসা জমি-বাড়ি অনেক উদ্বাস্তুর কল্পনাতেই পরে জমিদারির চেহারা নিত এবং তাতে হারানোর দুঃখ বহু গুণ বাড়ত। কিন্তু সেই দুঃখবিলাসে না মজে যা এত দিন ছিল না, তা হারানোর জন্য শোক করায় যুক্তি কোথায়? দ্বিতীয়টি নৈতিকতার প্রশ্ন। ছিটমহলের বাসিন্দাদের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন এটা। এ ক্ষেত্রে আপসের প্রশ্ন ওঠে কী করে?
ভারতীয় ছিটমহল মানেই তো সেই সব এলাকা ভারতের, বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের। অর্থাৎ, এই দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের অধিকার থাকার কথা তাদের নিজের নিজের দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো সব অধিকারই ভোগ করার। যেমন, স্বাধীন ভারতের নাগরিকেরা ১৯৫২ সাল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নিয়ে ভোট দিয়ে আসছেন। কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ভারতীয় সংবিধান তার নাগরিকদের যেসব মৌলিক অধিকার দিয়েছে, তার অন্যতম প্রতিটি নাগরিকের দেশের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাতায়াত করার ও বসবাস করার অধিকার। ছিটমহলের বাসিন্দারা সেই অধিকার স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরেও পায়নি।
একইভাবে ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের জীবন সম্পর্কে যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা থেকেও তারা বঞ্চিত। তাদের এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপই হলো ছিটমহল বিনিময় করে তাদের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে বসবাসের সুযোগ দেওয়া। ভারতের অন্য সব জায়গায় ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, স্কুলে মিড ডে মিল, শিশুদের জন্য অঙ্গনওয়ারি কর্মসূচি, সর্বশিক্ষা কর্মসূচিতে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ এখন ক্রমেই ছড়াচ্ছে। অতি সম্প্রতি খাদ্যনিরাপত্তা আইনের আওতায় দেশের গ্রামীণ এলাকার ৭৫ শতাংশ এবং শহর এলাকার ৫০ শতাংশ মানুষকে (মোট ৮২ কোটি মানুষ) আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ছিটমহলের মানুষেরা এসব থেকে বঞ্চিত। সেখানে রেশনের দোকান নেই, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, থানাও নেই। এককথায়, ভারত সরকারের প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থাই ছিটমহলের জন্য নেই। অথচ সরকার ছিটমহলগুলোকে ভারতীয় এলাকা বলে শনাক্ত করার সঙ্গেই এ কথাও স্বীকার করে যে সেই সব এলাকায় জনবসতি রয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের কথাও সে কারণেই। কিন্তু ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের সরকার কোনো পরিচয়পত্রেরই ব্যবস্থা করেনি। ফলে, এই পরিচয়হীন মানুষেরা এখন প্রকৃত অর্থেই ‘ঘরেও নহে, পরেও নহে’। ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির অন্যতম মুখপাত্র দীপ্তিমান সেনগুপ্তের তিক্ত মন্তব্যটি এখানে প্রণিধানযোগ্য—‘দেশভাগের আগে তো ওই সব ছিটমহলের বাসিন্দারা দেশের বাকি সব মানুষের মতোই ছিল। চলাফেরার স্বাধীনতা ছিল, অন্যান্য অধিকারও বাকিদের মতোই ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন গোটা দেশের মানুষ স্বাধীন হলো, তখন থেকেই ছিটমহলের মানুষেরা স্বাধীনতা হারাল।’
ছিটমহল বিনিময় হলে পশ্চিমবঙ্গ জমি হারাবে বা বেশি জনসংখ্যা তার ঘাড়ে চাপবে, এই কথাগুলোর মধ্যে যে চিন্তা লুকিয়ে আছে, তাও আমরা চিনি। ভিড়ের ট্রেনে অনেক কসরত ও ধাক্কাধাক্কি করে একবার উঠে পড়ার পরে সেই যাত্রীদেরই দেখা যায় কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে অন্য যাত্রীদের ঢুকতে বাধা দিতে। পশ্চিমবঙ্গের এই আপত্তির মূলেও আছে সেই সংকীর্ণ স্বার্থ। যেন, ছিটমহলের বাসিন্দাদের অধিকারের প্রশ্নটাই অবান্তর। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ (এ ক্ষেত্রে সরকার) চায় না, তাই ছিটমহলের মানুষের অধিকার নেই এ দেশ এবং এ রাজ্যের অধিবাসীদের সমান অধিকার ও সুযোগ পাওয়ার।
প্রশ্নটা তো ছিল দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় করে সেই সব এলাকায় এত দিন ধরে বসবাসকারী দুই দেশের নাগরিকদেরই তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। এর মধ্যে কোনো রাজ্যের (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের) আপত্তির প্রশ্নটা আসে কোথা থেকে? সংবিধান তো কোনো মানুষকে বা কোনো রাজ্য সরকারকে আলাদা করে এমন কোনো ক্ষমতা বা অধিকার দেয়নি, যার বলে সে বা তারা অন্য নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পেতে বাধা দিতে পারে। তাই কে বা কারা আপত্তি করল, তার জন্য ছিটমহলের বাসিন্দাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না কেন?
বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের সমাজের সর্ব অংশের মানুষ ছিটমহলের সমস্যা সম্পর্কে যেভাবে নীরবতা পালন করে চলেছে, তাতে তাদের মনোভাব স্পষ্ট। এই সুবিধাবাদী সমাজেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমেও। এর মধ্যে কোনো নৈতিকতা নেই, যেটা আছে তা স্পষ্টতই সংকীর্ণ স্বার্থপ্রসূত সুবিধাবাদ। একদিকে বাঙালি নিজেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের উদার মানবিকতাবাদের উত্তরাধিকারী বলে গর্ব করবে, অন্যদিকে ছিটমহলের মতো মানবিক সমস্যার মুখোমুখি হলেই সুবিধাবাদী অবস্থান নেবে, এই দ্বিচারিতা থেকে বাঙালি কবে মুক্ত হবে?
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।