‘আর কোনো দাবি নাই, ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে গত বুধবার জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন সরকারি দলের সাংসদ এস এম শাহজাদা। উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এলাকাবাসীর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি ত্রাণ নিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে জনগণের রোষানলে পড়তে হয়েছে। উপকূলের অনেক সাংসদকেই এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এলাকাবাসী ত্রাণ চান না, তাঁরা স্থায়ী বেড়িবাঁধ চান।
এই সাংসদ সত্য লুকাননি। বরং গলায় ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে সংসদ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি যেভাবেই নির্বাচিত হন না কেন অন্যান্য সংসদের মতো এলাকাবাসীর কথা ভুলে যাননি। এ জন্য এই সাংসদকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
এই সাংসদ আবার বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ভাগনে। অনেকে বলেন, মামার জোরেই তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সাংসদ হয়েছেন। গ্রাম দেশে ‘ভাগনে মামার চেয়ে বড়’ বলে যে কথাটি চালু আছে, এখানে শাহজাদা তা সত্য প্রমাণ করেছেন। গত সোয়া তিন বছর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে মামা বিবেকের দংশনে একবারও দংশিত হননি। বিনা ভোটের নির্বাচন, কারচুপি-জবরদস্তির নির্বাচন তিনি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে পরিচালনা করে গেছেন। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে, জবাব দিয়েছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ভাগ্যিস, তারা সে রকম কোনো শিক্ষা নেয়নি। নিলে সেসব দেশেও নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত হতো।
ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে যে জায়গা ভেঙে যায় সেখানে মেরামতের নামে চুনকাম করা হয়। কিছুদিন পর জোয়ারের পানিতে আবার তা ভেসে যায়। খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরের মালিকেরা নোনা পানি ঢোকানোর জন্য বাঁধ কেটেও দিয়েছেন অনেক স্থানে। এতে কৃষকের সর্বনাশ হলেও তাঁরা কিছু করতে পারেননি।
মামার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখন ভাগনের কথা বলি। তিনি আরও একটি কারণে ধন্যবাদ পেতে পারেন। এবারে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে পুরো উপকূলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে সেন্ট মার্টিন। এসব এলাকায় অন্তত ডজন দুই সাংসদ আছেন, যাঁদের ভোটাররা অতি কষ্টে দিন যাপন করছেন। উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে অনেক এলাকায় পানি ঢুকে ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষাকাল হওয়ায় এখনো সেই বাঁধ থেকে জোয়ারের পানি ভেতরে প্রবেশ করছে। ফলে কৃষকেরা আগামী আমন চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। অনেকের ঘরবাড়ি জোয়ারের সময় ডুবে যায়। এ অবস্থায় তাদের একটিই দাবি বাঁধ চাই। এই বিপন্ন ও অসহায় মানুষগুলো সরকারের কাছে ত্রাণ চায় না। চায় জীবনরক্ষাকারী বাঁধটা নির্মাণ করে দেওয়া হোক।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে উপকূলের প্রতিটি এলাকার বাঁধ কমবেশি ভেঙে গেছে। সেই বাঁধ ভেঙে এখনো জোয়ারের পানি ঢুকছে। কিন্তু একজন শাহজাদা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সাংসদ বিষয়টি সংসদে তোলার প্রয়োজন বোধ করেননি। দুর্যোগে ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড়ের পর কোন এলাকায় কত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, তার একটি হিসাব দিয়েছেন। তাঁর দায়িত্ব ত্রাণ দেওয়া। বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ড তথা পানিসম্পদমন্ত্রীর। কিন্তু পানিসম্পদমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। সংসদে তাঁকে কোনো বিবৃতি দিতে দেখিনি।
আমরা দেখেছি, খুলনা অঞ্চলের একজন সাংসদ স্পিডবোটে করে জনগণের স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজ দেখতে গিয়ে ধাওয়া খেয়েছিলেন। প্রথম আলোয় সেই ছবিও ছাপা হয়েছে। তারপরও কি সেখানে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত বা নির্মাণ করতে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা যায় না। মানুষ মন্ত্রী-সাংসদদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। তাঁরা ভাবছেন, কেউ তাঁদের সমস্যার সমাধান করবেন না। এ কারণে দুর্যোগের পর নিজেরাই বাঁধ মেরামত করতে লেগে যান। প্রশ্ন, তাহলে মন্ত্রী-সাংসদেরা কী করছেন?
পানি উন্নয়ন বোর্ডর স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, এই বাঁধ মেরামত করতে আড়াই কোটি টাকা প্রয়োজন। সেই টাকা না এলে তাঁরা মেরামতের কাজ করতে পারবেন না। আর তত দিন দশমিনা ও গলাচিপার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে হয়তো দুর্ভোগ পোহাতেই হবে।
উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। আইয়ুব খান সরকার এটি করেছিল। এরপর বাঁধ নির্মাণ হয়নি। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে যে জায়গা ভেঙে যায় সেখানে মেরামতের নামে চুনকাম করা হয়। কিছুদিন পর জোয়ারের পানিতে আবার তা ভেসে যায়। খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরের মালিকেরা নোনা পানি ঢোকানোর জন্য বাঁধ কেটেও দিয়েছেন অনেক স্থানে। এতে কৃষকের সর্বনাশ হলেও তাঁরা কিছু করতে পারেননি। কেননা চিংড়ি ঘেরের মালিকেরা ক্ষমতাবান। কৃষকেরা দুর্বল ও দরিদ্র। দরিদ্র মানুষ সবখানে মার খায়।
উপকূলের লাখ লাখ মানুষ যে প্রতিবার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, এ ব্যাপারে জনদরদি সরকারের কি কিছু করণীয় নেই? আইলার পর সিডর এল। সিডরের পর আম্পান। আম্পানের পর ইয়াস। কিন্তু রাষ্ট্রের অভিভাবকেরা বরাবর নির্বিকার থাকছেন। উপকূলের বিপন্ন ও বিধ্বস্ত মানুষকে রক্ষার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। বরং আমরা দেখছি উপকূলের রক্ষাব্যূহ নামে পরিচিত যে সুন্দরবন, তার ক্ষতি করে নানা উন্নয়ন প্রকল্প করা হচ্ছে।
বুধবার জাতীয় সংসদে সাংসদ এস এম শাহজাদার প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনের পর আমরা যোগাযোগ করি প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি শংকর দাসের সঙ্গে। তিনি জানান, গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনায় পৌনে ছয় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ মিটার সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অনেক গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ‘ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডর স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, এই বাঁধ মেরামত করতে আড়াই কোটি টাকা প্রয়োজন। সেই টাকা না এলে তাঁরা মেরামতের কাজ করতে পারবেন না। আর তত দিন দশমিনা ও গলাচিপার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে হয়তো দুর্ভোগ পোহাতেই হবে। একই অবস্থা বরগুনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও খুলনার উপকূলের মানুষেরও। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও পাউবোর চিঠি চালাচালিতে সময় পার করে দেবে, আরেকটি ঘূর্ণিঝড় না হওয়া পর্যন্ত তাদের চেতনা ফিরবে না। উপকূলের বিপন্ন মানুষকে নিয়ে বাঁধ মেরামতের এই মহড়া আর কত দিন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com