ভাগনেদের টিকিটবিহীন মামাবাড়ির আবদার

‘ভাইগন্যা হইলো মাথার তাজ’—দক্ষিণবঙ্গে এই কথার চল আছে। এখন দিনকাল খারাপ। এখন নিজের ভাগনে মাথার তাজ হলে বউয়ের ভাগনে মহাতাজ। রেল বিভাগের টিটিই (ট্রাভেলিং টিকিট এগজামিনার) মো. শফিকুল ইসলাম মহাতাজের মর্মার্থ ধরতে পারেননি। খোদ রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগনে পরিচয় দেওয়া তিন–তিনজন যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেনের এসি কেবিনে বসে থাকার ছোট্ট একটা আবদার করেছিলেন। তিনি সেই আবদারের দরদটা ধরতে পারেননি। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। তিনি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তাবৎ ভাগনে সম্প্রদায়ের জয় হয়েছে। ফেসবুকের বুকের ওপর ‘জয় মামার জয়, জয় ভাগনের জয়’ বলে বিকট দাপাদাপি চলছে। অবশ্য গতকাল রেলমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁরা তাঁর আত্মীয় নন।

ঘটনা হলো, গেল বিষ্যুদবার দিবাগত রাতে খুলনা থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল আন্তনগর ট্রেন ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’। পথে ঈশ্বরদী জংশন থেকে তিন ভদ্রলোক এসি কেবিনে চেপে বসলেন। টিটিই শফিকুল তাঁদের কাছে টিকিট চাইলেন। পরিস্থিতিটা অনেকটা ‘সময় নাই অসময় নাই, বাবু একখান টিকিট দ্যান’ টাইপের হয়ে দাঁড়াল। কারণ, ওই তিনজন টিকিটের চেয়ে বড় জিনিস দিলেন। সেটি হলো তাঁদের ‘পরিচয়’। কিন্তু শফিকুল বে–বোধের মতো তা না নিয়ে তাঁদের টিকিটই দিতে বললেন।

এরপর আলোচ্য ভাগনেত্রয় বিরক্ত হয়ে শফিকুলকে সুলভ কামরার তিনটি টিকিট দিতে বললেন এবং সেই টিকিটেই তাঁরা এসি কেবিনে বসে থাকার আবদার করলেন। এরপরও শফিকুল ৮০-৯০ দশকের সাইড নায়কের কায়দায় কর্তব্যে অবিচল অফিসারের মনোভঙ্গিতে জরিমানা ও সুলভের ভাড়া বাবদ মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে তাঁদের এসি কামরা ছাড়তে বললেন। এতে আরেক দফা কথা-কাটাকাটি হলো। তারপর ওই তিনজন এসি কামরা ছেড়ে শোভন কামরায় গিয়ে বসলেন। ট্রেন শুক্রবার ঢাকায় পৌঁছাল। কিছুক্ষণ পরই শফিকুলের মুঠোফোন বেজে উঠল। শফিকুলকে জানানো হলো, তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পশ্চিম রেলের পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন যাত্রীদের গতরের লোম খাড়া করা তথ্য দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, জরিমানা করার জন্য শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে তিনজন যাত্রী অশোভন আচরণ ও হয়রানির অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ পাওয়ার পর অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে।

নাসির উদ্দিনের কথায় আমরা জানতে পারলাম, কোনো যাত্রী যদি কোনো রেলকর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানি কিংবা অশোভন আচরণের অভিযোগ করেন, তাহলে সেই কর্মীর আর ‘বাঁচন’ নাই। ওয়ান-টুর মধ্যে অ্যাকশন হয়। এমনকি সেই কর্মী আসলেই যাত্রীদের হয়রানি করেছেন কি না, তা–ও তাঁর কাছে শোনার টাইম নাই। ঘচাঘচ বরখাস্ত। রেল বিভাগে এই ধরনের ইনসাফ জারি আছে এবং এই কালোবাজারির যুগে রেলের প্রতিটা টিকিট সাদাবাজারে বিক্রি হয়—এই সব কথা যাত্রীদের কেন এত দিন জানা ছিল না, সে জন্যই তো তাদের পাঁচ হাজার টাকার কারাদণ্ড অনাদায়ে তিন বছরের ফাইন করা উচিত।

রেলের এই ঘটনায় দুটো ঘটনার কথা মনে পড়ল।

এসব গল্প এখন বলে কোনো লাভ নেই। কারণ এখন ‘জন-জামাই-ভাগনা’র যুগ। স্বজনতোষণ ওরফে নেপোটিজমের যুগ। আর ‘নেপোটিজম মানে হলো নেপোয় মারে দই/ রামের খাবার শাম কেড়ে খায়, রাম পেল আর কই?’

ঘটনা ১.

১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ের কোনো একদিন। উত্তর প্রদেশের মোগলসরাইয়ে রেল বিভাগের একটা অনুষ্ঠান চলছে। রামদুলারি দেবী নামের এক বৃদ্ধা এসে নিরাপত্তাকর্মীদের বললেন, তাঁর ছেলে রেলে চাকরি করেন। ছেলেটির এখানে থাকার কথা। তিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চান। একজন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘মাইজি, আপকা বেটা কা নাম কেয়া হ্যায়?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘লাল। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।’ তাঁর কথায় নিরাপত্তাকর্মীরা অবিশ্বাসের সুরে হেসে ফেললেন। কারণ, এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির নাম লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। তিনি ভারতের রেলমন্ত্রী (তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভারতের রেলমন্ত্রী ছিলেন। পরে দেশটির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। তাঁরা প্রথমে ভাবলেন, এই বুড়ি পাগল। কিন্তু পরে তাঁর আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি আর সাবলীল কথা শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে লাল বাহাদুরের কাছে নিয়ে গেলেন। লাল বাহাদুর ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে বৃদ্ধাকে প্রণাম করলেন। তিনি সবাইকে জানালেন, বৃদ্ধা সত্যিই তাঁর মা। তিনি মায়ের সঙ্গে আলাদা করে কিছুক্ষণ কথা বললেন এবং লোকজনকে দিয়ে মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। এরপর তিনি বক্তব্য দিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকেরা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি আপনার মায়ের সামনে বক্তব্য দিলেন না কেন?’

রেলমন্ত্রী বললেন, ‘আমি যে একজন মন্ত্রী, সে কথা মাকে জানাইনি। তিনি জানেন, আমি রেলের ছোটখাটো একজন কর্মচারী। মা যদি জানতে পারেন, আমি রেলমন্ত্রী, তাহলে নানাজনের জন্য সুপারিশ নিয়ে আসবেন। তখন মহাবিপদে পড়ব। তাঁর কথা আমি মানতেও পারব না, আবার মাতৃ–আজ্ঞা ফেলতেও পারব না।’

ঘটনা ২.

সারা জীবনে একটা বাড়ি করতে না পারার কারণে ‘হোমলেস মিনিস্টার’ পরিচিতি পাওয়া লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ছেলে সুনীল শাস্ত্রী (কংগ্রেস নেতা ও উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী: পাস্ট ফরোয়ার্ড শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাবুজি রেলমন্ত্রী হওয়ার পর সরকার থেকে একটি শেভরোলেট ইম্পালা গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। একদিন আমি বাবুজির পারসোনাল সেক্রেটারিকে বললাম, তিনি যেন ড্রাইভারকে আমাদের বাসায় গাড়িটা নিয়ে আসতে বলেন। ড্রাইভার আসার পর আমরা গাড়িটা নিয়ে ঘুরতে গেলাম। পরের দিন বাবুজি ড্রাইভারকে বললেন, “তুমি কি লগবুকে গাড়ি কখন কতটুকু চালাও তা টুকে রাখো?” ড্রাইভার হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়লেন। গতকাল আমরা কতটুকু পথ চালিয়েছিলাম, তা বাবুজি তাঁকে জানাতে বললেন। ড্রাইভার জানালেন, ১৪ কিলোমিটার। তখন বাবুজি আম্মাকে বললেন, ১৪ কিলোমিটার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সরকারি গাড়ি ব্যবহারের জন্য তার খরচ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। তিনি টাকাটা আম্মাকে প্রাইভেট সেক্রেটারির হাতে দিয়ে দিতে বললেন।’

তবে এসব গল্প এখন বলে কোনো লাভ নেই। কারণ এখন ‘জন-জামাই-ভাগনা’র যুগ। স্বজনতোষণ ওরফে নেপোটিজমের যুগ। আর ‘নেপোটিজম মানে হলো নেপোয় মারে দই/ রামের খাবার শাম কেড়ে খায়, রাম পেল আর কই?’

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

sarfuddin2003@gmail.com