দেশের ব্যাংক খাতের কয়েকটি কালো অধ্যায় আছে। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের ৮ এপ্রিল। বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) পরিচালক হুমায়ুন জহিরকে ধানমন্ডির নিজের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে বিরোধের কারণে অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা ছিল সেটাই প্রথম। এর জন্য ইউসিবিএলের আরেক পরিচালক আখতারুজ্জামান বাবুকে দায়ী করে মামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পেয়ে পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, ফিরে আসেন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে।
পরের কালো অধ্যায়টির সময় ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট। আবারও সেই ইউসিবিএল। সেদিন ছিল পরিচালনা পর্ষদের সভা। পরের দিনের ইত্তেফাক–এ প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘অস্ত্রের মুখে আখতারুজ্জামান বাবুর ইউসিবিএল-এ পরিচালনা পরিষদ দখল’। তখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জাফর আহমেদ চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। আর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক।
ইত্তেফাক–এ ছাপা হওয়া সংবাদ অনুযায়ী, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নির্ধারিত বোর্ড মিটিং চলাকালে আখতারুজ্জামান বাবু, তাঁর ছেলেসহ ৫০ থেকে ৬০ জনের অস্ত্রধারী ক্যাডার অতর্কিতভাবে হামলা চালায়, পরিচালকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করে এবং মারমুখী অবস্থায় জোরপূর্বক প্রত্যেক পরিচালকের কাছ থেকে টাইপ করা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করে পদত্যাগে বাধ্য করে। অস্ত্রধারীরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ চৌধুরীকে নির্মমভাবে প্রহার ও বিবস্ত্র করে এবং দুজন পরিচালককেও মারধর করে। ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। এর পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো বোর্ড ভেঙে দেয়। পরে আদালতের আদেশে জাফর আহেমদ চৌধুরীকে বহাল করা হয়। সেই আখতারুজ্জামান আবার ব্যাংকের পর্ষদে ফিরে এসেছিলেন ২০১০ সালে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পরে।
হামলার শিকার ইউসিবিএল ব্যাংকের বিতাড়িত পরিচালকেরা পরের দিন (১৯৯৯ সালের ২৭ আগস্ট) অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইউসিবিএল ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি অর্থনৈতিক, যা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে। অন্যটি রাজনৈতিক, যা প্রধানমন্ত্রী দেখবেন।’
সাবেক অর্থমন্ত্রী সত্য কথাটিই বলেছিলেন। দেশে ব্যাংকের ক্ষেত্রে অর্থনীতি যেমন আছে, রাজনীতিও আছে প্রবলভাবে। আওয়ামী লীগের আরেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও পরে যেমনটা বলেছিলেন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। উদাহরণ দিয়ে আরও বলা যায়, ব্যাংকে একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকবে—এটি অর্থনৈতিক বিষয়, কিন্তু পর্ষদে এক পরিবার থেকে পাঁচজন সদস্য টানা নয় বছর থাকবেন—এটি কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আবার খেলাপি হলে ব্যাংক তা আদায়ের ব্যবস্থা করবে, এটি অর্থনৈতিক বিষয়, কিন্তু খেলাপিদের আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালের আরেকটি রাজনৈতিক ঘটনার কথা বলা যাক। এটা বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকেরই প্রয়াত ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তখন বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের আরেক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকেই পাঁচজন পরিচালক ছিলেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত জয়নুল হক সিকদার, বাকি চার পরিচালক সিকদার পরিবারেরই সদস্য। অথচ ২০১৪ সালের সেই সময়টায় ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকার কোনো সুযোগই ছিল না। এ অবস্থায় পরিচালকের সংখ্যা কমাতে ব্যাংকটিকে চিঠি দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করার কারণ দর্শানো হয়।
সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি ন্যাশনাল ব্যাংক। বরং তারা সেই চিঠি নিয়ে উচ্চ মহলে তদবির করে। এর পরের ঘটনা খুবই চমকপ্রদ। একটা সময় সরকার নিজেই আইন পরিবর্তন করে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকার সুযোগ করে দেয়। এ জন্য ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হয় ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন। একই আইনে বলা হয়, পরিচালকেরা টানা নয় বছর পর্ষদে থাকতে পারবেন, যা আগে ছিল ছয় বছর। এর মাধ্যমেই আসলে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, আগেই বলেছি এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক।
সন্দেহ নেই, ব্যাংকে নিজের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই পরিচালকদের মধ্যে যত বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও মারামারি। ব্যাংকে নিজের আধিপত্য থাকা মানেই বিশাল অঙ্কের তহবিলের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এমনিতেই ১৯৮২ সালে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এ খাতে নিয়মকানুনের কোনো বালাই ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনেক উদাহরণ আছে। ব্যাংকমালিক হয়েছিলেন ঋণখেলাপিরাও। এমনকি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর নিজের ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।
দেখা গেছে, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতের ২৮টি ব্যাংকের ১৫২ জন পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকেই নিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। ব্যাংক গঠনে এসব পরিচালকের বিনিয়োগ করা অর্থের তুলনায় ২০ গুণ বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে যান তাঁরা। এর বাইরে বেনামে, প্রতারণা বা জালিয়াতি করে নেওয়া ঋণ তো ছিলই। এ নিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটির মন্তব্য ছিল, ‘স্পষ্টতই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যাংক পরিচালক আমানতকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করিয়া তাহাদের মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহকে নিজস্ব অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করিয়াছেন।’
পরিস্থিতি সামাল দিতে এরপরই নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৯৯৯ সালের ৫ আগস্ট দেওয়া সার্কুলারে বলা হয়েছিল, ব্যাংকের পরিচালক বা পরিচালকের আত্মীয়স্বজনের নামে নেওয়া ঋণ ব্যাংকে পরিচালকের ধারণ করা শেয়ারের পরিশোধিত মূল্যের ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এই নিয়ম জারির পরে ধারণা করা হয়েছিল বেসরকারি ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তবে একটা কাজ ঠিকই হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে আন্তসম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। কেননা, তাঁদের তো অন্য ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হয়েছে। নামে নেওয়া ঋণ তো ছিলই, বেনামে নেওয়া ঋণই বরং বেশি। ফলে সেই থেকে পারস্পরিক লেনদেনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন ব্যাংক পরিচালকেরা। পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সার্কুলারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
হামলার শিকার ইউসিবিএল ব্যাংকের বিতাড়িত পরিচালকেরা পরের দিন (১৯৯৯ সালের ২৭ আগস্ট) অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইউসিবিএল ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি অর্থনৈতিক, যা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে। অন্যটি রাজনৈতিক, যা প্রধানমন্ত্রী দেখবেন।’
এরপর বেসরকারি ব্যাংকের সমস্যা তখনই হয়েছে, যখন কোনো কারণে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এই যেমন এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে সিকদারপুত্রদের গুলি করা। এই দুই ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক ঋণের পরিমাণ অনেক। এমনকি বেনামেও নেওয়া ঋণ আছে। কিন্তু হঠাৎ কী হলো বলা মুশকিল। হয়তো প্রকল্পটাই ছিল অবাস্তব, ঝুঁকি নিতে চায়নি এক্সিম ব্যাংক। এর পরিণতিতে এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়াকে অস্ত্রের মুখে ধরে এনে হুমকি ও গুলি। নিঃসন্দেহে এই ঘটনা ব্যাংক খাতের আরেকটি কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে।
দেশের ৩৯ বছর বয়সী বেসরকারি ব্যাংকের মূল্যায়ন করলে দেখা যাচ্ছে, যেসব ব্যাংক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়েছে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ব্যবস্থাপকদের হাতে ব্যাংক পরিচালনার ভার ছেড়ে দিয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ কেবল পরিবেশ তৈরি ও নীতি প্রণয়নের কাজের মধ্যে ছিল, তারাই ভালো করেছে। এই নীতি অনুসরণ করে একসময়ের খারাপ ব্যাংক এখন দেশের ভালো ব্যাংকের পরিচিতি পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইবিএল বা দ্য সিটি ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের কথা বলা যায়। আর ভালো ব্যাংক খারাপ হওয়ার তালিকায় আছে ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি।
নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুযোগ, এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকার বিধান—সরকার সবই করেছে একশ্রেণির ব্যাংকমালিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য। বিনিময়ে মালিকেরা দিয়েছেন আনুগত্যসহ জানা-অজানা অনেক কিছু। পারস্পরিক এই লেনদেনের সম্পর্ক থাকলে ব্যাংক খাতে কালো অধ্যায় তৈরির ঝুঁকিও থেকে যাবে।
ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটাতে ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে ব্যাংকমালিকদের চাপে শেষ পর্যন্ত কমিশন গঠন হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো কারণেই হোক ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধন্যবাদ। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি অন্য সবার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা নিতে পারে, তাহলেই হয়তো কিছুটা কাজ হবে। কারণ, ব্যাংক রাজনীতি করার জায়গা নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
l শওকত হোসেন প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
shawkat.massum@prothomalo.com