ব্যবসায়ীদের ‘হাতের পুতুল’ কেন ভোক্তারা?

আজ ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটি পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন। ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের ভোক্তা সংগঠনগুলোর ফেডারেশন কনজ্যুমার ইন্টারন্যাশনাল (সিআই) ভোক্তা অধিকার প্রচারণার একমাত্র সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। বিশ্বের ২৫০টি দেশ সংগঠনটির সদস্য। বাংলাদেশের একমাত্র ও শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কনজ্যুমার ইন্টারন্যাশনালের পূর্ণাঙ্গ সদস্য। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও সংগঠক রাল্ফ নাদের। সিআই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় এসব সংগঠন প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ক্রেতাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে, সেটা আজ এক বড় প্রশ্ন।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২২–এর এবারের প্রতিপাদ্য হলো—ফেয়ার ডিজিটাল ফিন্যান্স বা ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থায় ন্যায্যতা। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন এখন অনেক কিছুই ডিজিটাল বা অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে এবং প্রতিদিন এ খাতে ভোক্তাদের ঝুঁকির নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। তাই অনলাইন কেনাকাটা বা আর্থিক লেনদেন যেন স্বচ্ছ হয়, এখানে যেন কোনো ধরনের প্রতারণা বা অনিয়ম না হয় এবং গ্রাহকেরা যেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার পান সে বিষয়ে সরকার, সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উৎপাদক, বিক্রেতা ও সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ যেন দায়িত্ববান হন সেই আহ্বানই আমরা পাচ্ছি এবারের প্রতিপাদ্য থেকে।

করোনার বিধিনিষেধের সময় যখন মানুষ ঘরবন্দী, তখন অনলাইন কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর ফাঁকে একটি বিশেষ সময়ে ধামাকা অফারের নামে বিপুল অঙ্কের মূল্যছাড়ের অফারে ই-কমার্সভিত্তিক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে আগাম অর্থ পরিশোধ করে পণ্য ডেলিভারি না পেয়ে এখন আহাজারি করছেন লাখ লাখ গ্রাহক ও উদ্যোক্তা। আবার অনেকে ক্যাম্পেইন-ভেদে পণ্য সরবরাহ করার কথা ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে। কিন্তু সেই শর্ত কখনোই মানে না প্রতিষ্ঠানটি। কখনো ৬০, কখনো ৯০ দিনে পণ্য দেওয়া হয়। আবার কখনো পণ্য দেওয়া হয় না, টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না। অনেক সময়, টাকা বুঝে পাওয়ার পরও পণ্য না দেওয়া। বিশেষ করে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলি প্রায়ই অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ ও কূটকৌশলী বাক্যে ভরপুর থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ইংরেজি ভাষা, যা সাধারণের বোধগম্য নয়। কখনোবা অক্ষরগুচ্ছ এমনভাবে সাজানো থাকে যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া সেসবের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

ভোক্তা অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। কারণ, ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার সম্পর্ক নিবিড়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভোক্তারা বরাবরই পণ্য ও সেবা—উভয় ক্ষেত্রেই অনায্যতার শিকার। ভোক্তারা অসচেতন, অসংগঠিত, স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী ভোক্তা সংগঠনের দুর্বলতা ও আইনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার না থাকার কারণে প্রবঞ্চনার হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

প্রতারকেরা যেসব অপকর্ম করে থাকেন তা হলো, দামি পণ্যের অর্ডার নিয়ে কম দামি পণ্য সরবরাহ করা, ত্রুটিপূর্ণ-নিম্নমানের পণ্য দেওয়া, গ্রাহকের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত আচরণ না করা, মিথ্যা, বাহারি ও নামীদামি তারকা, মডেল ও খেলোয়াড়দের ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়া ও পণ্যের মজুত না থাকলেও অর্ডার নেওয়ার মতো প্রতারণা করে যাচ্ছে এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান। প্রতারণার আরেক ধাপ হলো, দুর্বোধ্য ও ভোক্তা স্বার্থবিরোধী শর্ত জুড়ে দেওয়া। শর্তগুলো এত ছোট অক্ষরে ও কঠিন ভাষায় লেখা থাকে, যা অনেকেরই বুঝতে কষ্ট হয়। আর এসব শর্ত দিয়ে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ভোক্তাদের বোকা বানায়। আর অধিকাংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ ডেলিভারি পয়েন্ট ভোক্তাবান্ধব নয়। সেখানে গেলে ক্রেতাকে অনেক ক্ষেত্রে নাজেহাল হতে হয়। কখনো কখনো অর্ডার করা পণ্যের আংশিক সরবরাহ করে বাকি পণ্য দেওয়া হয় না। স্পেশাল ইভেন্ট যেমন ঈদ, পূজার সময় লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নিলেও সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করা হয় না। আর প্রতারণার শেষ ধাপটি হলো, রিফান্ড ওয়ালেটে ফেরত দেওয়া ও পণ্য কিনতে বাধ্য করা ইত্যাদি।

মুঠোফোনে আর্থিক সেবাগুলোর (এমএফএস) গলাকাটা ক্যাশ আউট চার্জ আদায়ের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য ডিজিটাল আর্থিক সেবা আশীর্বাদ না হয়ে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমএফএসগুলোর গুরুতর অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো ক্যাশ আউট চার্জ অনেক বেশি। আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা ক্যাশ আউট চার্জ কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারীদের পরামর্শ দিয়েছেন। লেনদেনের উচ্চ চার্জ গ্রামাঞ্চলের মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং ছোট উদ্যোক্তাদের সেবা থেকে দূরে রেখেছে। মুঠোফোনে ক্যাশ আউটের উচ্চ রেটের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত, নতুন উদ্যোক্তা ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদ, ইউক্যাশ, এমক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ দেশে ১৬টি প্রতিষ্ঠান এমএফএস কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

আর্থিক লেনদেন ও কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডের অত্যধিক সুদের হারে সাধারণ গ্রাহকেরা প্রবঞ্চনার শিকার হন। ক্রেডিট কার্ডের বিশাল অঙ্কের সুদের হার, সুদের সঙ্গে নানা ধরনের মাশুল, একবার মাসের কিস্তি খেলাপি হলে ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দেওয়ার মতো আচরণ কাবুলিওয়ালাদেরও হার মানায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কোভিড-১৯ মহামারির মতো সংকট এই ঝুঁকিগুলোকে বাড়িয়েছে, যেখানে দুর্বল গ্রাহকেরা অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে আরও ভঙ্গুর। সবার জন্য ন্যায্য ডিজিটাল ফাইন্যান্স অর্জনের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী, সহযোগিতামূলক ও সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন।

কনজ্যুমারস ইন্টারন্যাশনালের মতে ২০২৪ সাল নাগাদ ডিজিটাল ব্যাংকিং গ্রাহক ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে (জুনিপার রিসার্চ, ২০২০)। উন্নয়নশীল বিশ্বে, হিসাবের মালিকদের ডিজিটালভাবে অর্থ প্রদান পাঠানো এবং গ্রহণ করার অনুপাত ২০১৪ সালে ৫৭ শতাংশ থেকে ২০১৭ (Findex ২০১৭)–এ ৭০ শতাংশ হয়েছে। ৩৯ শতাংশ কোম্পানি ফিনটেক গ্রহণকে উচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আরও উদ্ভাবনী আর্থিক ল্যান্ডস্কেপের (JDSpura, ২০২০) জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা হাইলাইট করছে। ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবাগুলো ঐতিহ্যগত ঝুঁকিগুলোকে বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে, যা ভোক্তাদের জন্য অন্যায্য ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং ক্রমবর্ধমান নগদহীন সমাজে যারা দুর্বল, তাদের পেছনে ফেলে দিতে পারে।

ভোক্তা অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। কারণ, ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার সম্পর্ক নিবিড়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভোক্তারা বরাবরই পণ্য ও সেবা—উভয় ক্ষেত্রেই অনায্যতার শিকার। ভোক্তারা অসচেতন, অসংগঠিত, স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী ভোক্তা সংগঠনের দুর্বলতা ও আইনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার না থাকার কারণে প্রবঞ্চনার হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সে জন্যই বাংলাদেশের ভোক্তাদের বলা হয়ে থাকে হেল্পলেস কনজ্যুমারস বা অসহায় ক্রেতা-ভোক্তা।

বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাই পণ্যের নিয়ামক। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের রাজার সম্মান প্রদান করা হলেও আমাদের দেশে পরিস্থিতি তার উল্টো, বরং ব্যবসায়ীরাই নির্ধারণ করেন ভোক্তারা কোন পণ্যটি হজম করবেন। আবার দাম নির্ধারণেও ব্যবসায়ীদের ভূমিকাই মুখ্য। ভোক্তারা এখানে অনেকটাই হাতের পুতুল। ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সরকার, রাজনৈতিক দল, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তা স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করবে। বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। অতিরিক্ত সুদ, নামে–বেনামে সার্ভিস চার্জ আদায় ও ভোগান্তির মাত্রা চরম হলেও গ্রাহকেরা এখানে অভিযোগ করতে অনাগ্রহী। তাই গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে এ সংক্রান্ত সেলটি পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ই-কমার্স কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আদলে গণশুনানির আয়োজন করা এবং বিভাগের কার্যক্রম নজরদারির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও ক্যাব প্রতিনিধি সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় মনিটরিং কমিটি গঠন করলে হয়তো গ্রাহকের ভোগান্তির মাত্রা কিছুটা কমতে পারে।

এস এম নাজের হোসাইন ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)