একজন শিক্ষকের একটি করুণ আবেদনের কথা বলি—বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের চেয়ে এক ক্লাস বড়। নাম হারেস। গত বছর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান কোর্সে ভর্তি পরীক্ষার সময় আমাকে ফোন দিয়ে বলছিলেন, ‘তুহিন, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। তিনি পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে চান। শুধু তা-ই নয়, বারবার করে আমাকে ফোন করতে থাকলেন। পরিদর্শকের তালিকা থেকে তিনি যেন কোনো অবস্থাতেই বাদ না পড়েন। পরদিন নিজেই এসে উপস্থিত। প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন। তাঁর এই পরিদর্শকের দায়িত্ব চেয়ে নেওয়া দেখে আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি এটাতে এত আগ্রহী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বললেন, ১০ বছর থেকে তিনি একটি কলেজে পড়ান, কিন্তু সেই কলেজের এখন পর্যন্ত বেতন পাননি। পরিবারের যে করুণ চিত্র তিনি বর্ণনা করলেন, তাতে করে চোখ আর্দ্র হওয়ার মতো। তিনি হিসাব করে বলছেন, ছয়টি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পেলে তিন হাজার টাকা পাবেন। তাঁর ছোট্ট মেয়ের কী একটা ছোট্ট আবদার আছে, সেই টাকা থেকে তাঁর মেয়ের আবদার পূরণের কথা বলছিলেন। অনেক কষ্টের কথার মধ্যেও তাঁর একটি স্বপ্ন ছিল, আগামী বাজেটে অবশ্যই তাঁদের জন্য বরাদ্দ রাখবে সরকার। কারণ, নির্বাচনী বাজেট হবে, সেখানে ভোটের কথা বিবেচনা করে হলেও নন-এমপিও শিক্ষকদের জন্য বেতনের ব্যবস্থা অন্তত হবে।
হারেস ভাই, এ বছরেও আপনাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ নেই। সামান্য কিছু টাকা শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ আছে, যা আপনাদের নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কি না, তা বলা নেই। যদি তা না হয়, তাহলে ধরে নিতে পারেন, আগামী পাঁচ বছর অন্তত নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন হওয়া কঠিন। আপনার ছোট্ট মেয়ে তত দিনে বড় হবে, বুঝতে পারবে আপনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান। তখন হয়তো আর কোনো দিন আপনার কাছে কোনো কিছুর জন্য কোনো আবদার করবে না। ‘কলুর বলদ’ বাগ্ধারা পড়তে গিয়ে আপনার করুণ মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে বারবার ভেসে আসবে। মেয়ের চোখের জলে হয়তো বই ভিজবে। অনেকের হয়তো এখনো ভেজে। সে হয়তো তখনো বুঝতে শিখবে না এই ব্যর্থতার দায় তার বাবার নয়, রাষ্ট্রের।
পেশাজীবীদের শ্রেণীবিন্যাস করলে শিক্ষকেরা একটি শ্রেণীভুক্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—সবাই একটি শ্রেণীর। শিক্ষকদের কেউ বিপদে পড়লে স্বশ্রেণীর কথা বিবেচনা করে, প্রথমত শিক্ষকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বছরের পর বছর শিক্ষকদের একটি অনেক বড় অংশ বেতনহীন হয়ে থাকবে আর বেতনভোগী শিক্ষকেরা দর্শকের ভূমিকায় থাকবেন, এটা হতে পারে না। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষকদের আর্থিক সম্মান বৃদ্ধির কত গল্পই না আমরা শুনেছি। শিক্ষা কমিশন হবে, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো হবে, শিক্ষা গবেষণায় বড় ভূমিকা রাখবে। সরকারের মেয়াদ আর মাত্র কয়েক মাস আছে। এখন আর এসব আশার বাণী শোনা যায় না। কিন্তু পাঁচ-সাত-দশ-পনেরো বছর ধরে যে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান না, তাঁদের করুণ বাস্তবতা কি দূর হবে না? হারেস ভাইদের কি তবে কোথায় পরীক্ষার পরিদর্শক হওয়া যায়, কিংবা শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ কিংবা পরীক্ষার সময়ে যে চার শ-সাড়ে চার শ টাকা পাওয়া যায় সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনতে হবে। দেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করা হলো। অথচ, যাঁরা বেতন পান না, তাঁদের বেতন পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত হলো না। সারা দেশে যে শিক্ষকেরা আমরা বেতন পাই, তাঁদের এখন উচিত বেতনহীনদের পাশে দাঁড়ানো। এ বাজেটে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা না হলে শিক্ষকেরা বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলবেন, সেটা সরকারের নির্বাচনী বছরের জন্য ভালো খবর হবে না। তাঁরা আন্দোলনে নামবেন এবং আগামী নির্বাচনে নন-এমপিও শিক্ষকেরা হয়তো বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেই কাজ করবেন। চারদলীয় জোট সরকারও যে তাঁদের এমপিওভুক্ত করেনি, সেটা হয় তাঁরা ভুলে যাবেন, নয়তো তাঁদের মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজবে নতুন করে।
দেশের অর্থ অপাত্রে কিংবা অপরিকল্পিতভাবে ব্যয় হোক, এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়। কিন্তু, বিনা পারিশ্রমিকে সরকার কারও কাছ থেকে শ্রম সংগ্রহ করুক, এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়। এমপিওভুক্ত কিংবা নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিত হওয়া খুবই জরুরি। দেশে এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখান থেকে মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন হয়তো তিনজন-পাঁচজন। সেখানে হয়তো পড়ান ১৫-২০ জন শিক্ষক। পাশাপাশি হয়তো একই পর্যায়ের বিভিন্ন নামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানগুলো একত্র করে একটি প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি একই ক্লাসে ১০ জন করে শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে দুই প্রতিষ্ঠান মিলে একটি করলে এক প্রতিষ্ঠানে ২০ জন শিক্ষার্থী পড়বে। যেসব নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে, সেগুলোর বেতন দিয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যেতে পারে। ক্রমান্বয়ে জনবলও কমানো যাবে। নির্মম হলেও এই পদ্ধতি জাতীয় স্বার্থে। কিন্তু যে নির্মমতা এখন প্রদর্শন করা হচ্ছে, তা ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় বলেই বিবেচিত হবে।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উচিত আদালতের আশ্রয় নেওয়া। দেশে এমন কোনো আইন আছে কি না যে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম সংগ্রহ করা যায়, সেটাও দেখা প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী যখন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির ফল প্রকাশ করার সময় এ প্লাসের সংখ্যা বৃদ্ধিতে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে স্বস্তির ঢেকুর তোলেন, তার আড়ালে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের পরিবারের দীর্ঘশ্বাস আছে, সেটা কি ভুলে যান? শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৩৩তম সভায় নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিসহ প্রায় সব সাংসদই নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে আগ্রহী। তার পরও বাজেটে তাঁদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। কত বড় আকাশছোঁয়া বাজেট, অথচ শিক্ষকদের বেতন নেই!
ড. তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com