গত বেশ কয়েক দিন ধরে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ তাই সারা সপ্তাহ এই গরমে কাহিল হয়ে শুক্রবারের দুপুরে খেয়েদেয়ে হাত–পা ছড়িয়ে বিশ্রামের বদলে কাঠফাটা রোদে ব্যানার হাতে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বোকামি খুব বেশি মানুষ করবে বলে মনে করার যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছিল না৷ তাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে যখন প্রেসক্লাবের সামনে সারি সারি লোকজনকে দেখলাম সাদা টি-শাের্ট শুধু দাঁড়িয়েই নয় ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে মাইকিং করছে এবং স্লোগান দিচ্ছে তখন একটু অবাক আনন্দ অনুভব না করেই পারলাম না৷
স্টপ পয়জনিং আস (stop poisoning us) এর জুতসই বাংলা কি উপরোক্ত শিরোনাম হতে পারে? এ ইংরেজি শিরোনামের উদ্যোগ সম্বন্ধে প্রথম জানতে পারি ফেসবুকের একটি ইভেন্টের মাধ্যমে৷ মূলত যে ভয়াবহ রকমভাবে আমাদের খাদ্যে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, সেই সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি করতে এবং তার প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাতেই এ উদ্যোগের জন্ম৷
খাদ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, ১৫০ রকম খাদ্য আছে বাংলাদেশের বাজারে৷ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে মতভেদে এসব খাদ্যের মধ্যে রাসায়নিক মিশ্রিত ভেজালের পরিমাণ ৭০ থেকে ৯০ ভাগ৷ আপনি যদি নিম্নসীমা ৭০ ভাগও ধরেন, তার পরও দুই–তৃতীয়াংশের ওপর খাবার হচ্ছে বিষাক্ত৷
এ বিষাক্ত খাবারগুলোর ধরনও মোটামুটি সবার জানা৷ ফরমালিন মাছে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফলমূলে, ইটের খোয়া গুঁড়া মরিচে, চাল ও মুড়িতে ইউরিয়া ইত্যাদি ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক রকম কৌশল৷ এর ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ রোগগুলোও আমাদের অজানা নয়৷ এসব রাসায়নিক হতে পারে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বাচ্চাদের অ্যাজমাসহ আরও অনেক জীবন বিপর্যয়কারী রোগের কারণ৷
যেটা আগে বললাম, খাদ্যে রাসায়নিক মিশ্রণ এবং এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যবিষয়ক বিপর্যয়
সম্বন্ধে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে কিন্তু মোটামুটি সবাই কমবেশি সচেতন৷ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এ ব্যাপারে একধরনের নিষ্ক্রিয়তা৷ এটা অনেকটা জেনেশুনে বিষ করেছি পানের মতোন৷
এ জেনেশুনে বিষ পান করার মানসিকতার একটা ব্যাখ্যা এ রকম হতে পারে৷ সেটা হলো যে আমরা সেসব বিষয়ে শুধু খুব সক্রিয় হই, যখন আমাদের নিজেরা তাৎক্ষণিকভাবে বিপন্ন বোধ করি৷ একটা উদাহরণ দিই৷ আজ যদি আমরা দেখতাম যে ফরমালিনযুক্ত একটা রুই মাছের ঝোল বা কার্বাইডযুক্ত আম খেয়ে একটু পরেই বিছানায় কাতরাচ্ছি তাহলে হয়তো আমরা অনেক বেশিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতাম৷
সেটি না হয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি যেহেতু খুব আস্তে আস্তে হচ্ছে এবং সুস্পষ্ট কার্যকারণ বের করা যাচ্ছে না তাই এ ব্যাপারে একটা নিষ্পৃহ আচরণ আমাদের মধ্যে রয়েছে৷ কী খেয়ে কোনটা হচ্ছে, কেমিক্যালযুক্ত আম খেয়ে হলো, নাকি ফরমালিনযুক্ত মাছ খেয়ে হলো, আর এগুলো আসার আগেও তো যে ক্যানসার বা লিভারের ক্ষতি হয়িন তা তো না—এসব ভাবনা মিলিয়ে একটা দ্বন্দ্ব আমাদের মধ্যে আছে৷ তাই এ নিয়ে আমরা ভুক্তভোগী জনতার মধ্যে এ অবস্থার বিরুদ্ধে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া সেভাবে তৈরি হচ্ছে না৷
আরেকটা ব্যাপার আমার যেটা মনে হয় সেটা হলো ঝুঁকিটা যেহেতু সামষ্টিক, তাই এ নিয়ে ভয়টাও সবার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে৷ আরে মরলে তো সবাই একসঙ্গেই মরব৷ আর আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার একটা অমোঘ প্রবণতা তো আছেই৷ তাই আমরা মনে করি যে ভাই এত চিন্তা করে লাভ নেই৷ ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে৷
আমরা আমাদের নিজেদের ব্যাপারে এ রকম উদাসীন ভাব দেখালেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে এই নিষ্পৃহ থাকাটা একটা অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়৷ আপনার ছোট্ট সন্তানটিকে হয়তো দেখছেন যে সুন্দর সুস্থ অবস্থায় রয়েছে৷ কিন্তু আপনি অনেকটা জেনেশুনেই একটু একটু করে বিষ ঢালছেন তার নিষ্পাপ প্রাণবন্ত এ শরীরটায়৷ একদিন যখন এর ভয়াবহ রূপ আমাদের সামনে এসে নির্মমভাবে আঘাত করবে, তখন কাকে কীভাবে জবাব দেব আমরা? নিজেকে কী বলে তখন সান্ত্বনা দেব আমরা? আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়েছে?
আর সত্যি কথা বলতে কী, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের হাতে মানববন্ধন, মিটিং–মিছিল করা ছাড়া কিন্তু বিশাল কোনো ক্ষমতা নেই৷ ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা ব্যাপারটি নিয়ে ঠিক কতটুকু চিন্তিত, তা আমার জানা নেই৷চিন্তিত বা চিন্তিত নয় কি না, সেটা হয়তো সে রকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়৷ যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা৷ কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কিছুর নাম–নিশানা এখনো দেখা যাচ্ছে না৷
তাই আমাদের আমজনতাকেই এ আত্মঘাতী নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে আসতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করতে হবে৷ গত ২৩ মে শুক্রবার প্রেসক্লাবের সামনের মানববন্ধন এ প্রক্রিয়ার মাত্র প্রথম ধাপ৷ যেতে হবে আরও অনেক অনেক দূর৷
ড. রুশাদ ফরিদী: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
rushad@econdu.ac.bd