বিষাদ আছে, আছে প্রাণও

সন্‌জীদা খাতুন
 সন্‌জীদা খাতুন

সংস্কৃতির ললিত রূপ মোহন সুরে এমনভাবে কাজ করে চলে মানুষের গভীরে যে ঠিক ঠাহর করা যায় না, কাজটা কী হচ্ছে। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান এমনই অলক্ষ্যে এতটা বছর এ দেশের মানুষকে প্রাণিত করে আসছিল। গত শতকের সেই ষাটের দশকে ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ আয়োজন প্রতিবছর যেন নিজেকে ছাপিয়ে গেছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি তার স্বরূপের সন্ধানে এসেছে বটমূলে, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ তখন আর আবাহন-গান হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে ঘরে ফেরার গীত। সাম্প্রদায়িক-শোষক-নিপীড়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র গড়ার পথে ক্রমশ ঝুঁকেছে এ দেশের মানুষ। বৈশাখের ভোরে রমনা বটমূল থেকে গানের শান্ত আগুন নিয়ে আমরা অন্তর শাণিত করেছি। বাঙালি সংস্কৃতি আর আমাদের স্বাধীন বিকাশের পথে বাধা এলে রুখে দাঁড়িয়েছি।

১৯৭১ সালে কোনো গান বেজে ওঠেনি রমনার বটমূলে। কারণ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে তখন একটিই গান—মুক্তির গান। মনে আছে, সাভারের জিরাব গ্রামের মাটির ঘরে নিজের সন্তানদের নিয়ে বসে গান গেয়ে বটমূলের প্রভাতি পরিবেশ স্মরণ করেছি।

তারপরও বহু বিরুদ্ধ পরিবেশে পথ চলেছি আমরা। পথে পথে পাথর এসে রোধ করতে চেয়েছে পথিককে, কিন্তু বৈশাখের এক তারিখে, পথিকের অনিবার্য গন্তব্য হয়েছে রমনার বটমূলে। বাঙালিত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক সকালের সুর হয়েছে নিত্যদিনের সাহস। একসময় বোমা মেরে রক্তাক্ত করা হলো রমনার বটমূল। নিহতের শোক আর আহতের আর্তনাদ ছাপিয়ে আমরা আবার দাঁড়ালাম বুক বেঁধে। আমরা একা তো নই, সঙ্গে গোটা দেশবাসী। ভয়কে জয় করার নামই তো নববর্ষের ভোর।

অকস্মাৎ মানুষের পৃথিবীতে তার ভোর থেকে রাত্রির গায়ে পড়ে গ্রহণের দাগ। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ আমাদের চেনা পৃথিবীটাকেই পাল্টে দিল। গত বছর এবং এবার পয়লা বৈশাখের কালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের প্রাণের উৎসব, বটমূলে বর্ষবরণকে ব্যাহত করছে। দেশের প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা বিধানই এখন প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এই মহামারি আমাদের বহু স্বজনকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এখনো দেশে-বিদেশে হাসপাতালে, বাড়িতে বহু মানুষ এই রোগের সঙ্গে লড়ছে।

তবু আশা ছাড়া আর কোনো বিকল্প তো জানা নেই। আজকের দিনে শুধু এটাই বলি, মানুষের ইতিহাসে বিষাদ একটা বড় সত্য বটে, কিন্তু ধ্বংস কোনো সত্য নয়। মানুষ বাঁচবে, জাগবে এবং অনন্তের আলো জ্বালবেই।

শুভ নববর্ষ ১৪২৮।