অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা এবং রাজশাহী শহরবাসী। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তাঁরা এই দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে সংঘটিত ঘটনার কারণে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে।
আদতেই গত কয়েক মাসে দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীল অবস্থা, হরতাল-অবরোধের কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকমতো হয়নি। মাত্র পুরোদমে শুরু হয়েছিল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিন্তু আবার আকস্মিকভাবে বন্ধ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। এক জরিপে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা ৮৩ জন শিক্ষার্থী পড়তে আসেন নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে। ওই অভিভাবকেরা প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী। বেশ কিছু অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে পড়ালেখা করান গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংক থেকে নিয়মিত কিস্তি প্রদানের শর্তে ঋণ নিয়ে। কিন্তু সন্তানদের শিক্ষাকাল প্রলম্বিত হলে শঙ্কায় পড়েন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য সর্বাধিক দাবি আসে তাঁদের কাছ থেকেই। এবারও তাঁরা সে দাবিই করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যান বা বলা যায় যেতে বাধ্য হন। শিক্ষকেরাও অনেকে এ সময় কর্মস্থলের বাইরে চলে যান। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শহরের ওপর। মেস, ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক, মুদি-মনিহারি দোকানি এমনকি মাছ-মুরগি, তরি-তরকারিওয়ালারাও তাঁদের বেসাতি নিয়ে সংকটে পড়ে যান।
রাজশাহীর বৃহত্তম ব্যবসায়ী সংগঠন ‘রাজশাহী বিভাগীয় ঐক্য পরিষদ’-এর সহসভাপতি রিয়াজউদ্দীন আহমেদ জানান, হরতাল-অবরোধ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে, আরডিএ মার্কেটের প্রায় নয় হাজার মালিক-কর্মচারীর পরিবারকে আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়। যেখানে ওই মার্কেটে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকা লেনদেন হয়, তা এ সময় গিয়ে এক কোটিতেও পৌঁছে না। তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই যথাশিগগির বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান।
ঈপ্সিত যাত্রী পান না রিকশা, অটো, টেম্পোর চালকেরাও। দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা ও বিভাগীয় শহর রাজশাহী। শহর ও শহরতলি মিলে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের রুটি-রুজির বলতে গেলে অন্যতম অবলম্বন এই বিশ্ববিদ্যালয়। স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে তাঁরা সংকটে পড়েন, দুবেলা খাবারের সংস্থান তাঁদের অনেকেরই হয় না।
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হচ্ছে, শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার কারণে, শিক্ষার্থীদের দলীয় কোন্দল ও সংঘাতের কারণে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে অধিকারের প্রশ্নে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় তো কেবল জ্ঞান আর নীতিকথা শেখার আশ্রম নয়, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অধিকার সংশ্লিষ্ট সবারই থাকবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বিকাশ, মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও নৈতিক সততা বজায় রাখার জন্য এরা সভা-সমিতি, সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হবে, হওয়াটাই স্বাভাবিক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনা হয়তো সেই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগেরই একটি পর্যায়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে সেই অধিকার শিক্ষার্থীরা কতটা কীভাবে করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিধিসম্মতভাবে নিশ্চয়ই তা খতিয়ে দেখবে। দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। আইন তার গতিতে অগ্রসর হবে। এ অবস্থায় অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চান, কর্তৃপক্ষ যেন কালবিলম্ব না করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যবস্থা করে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ শিক্ষক আমাকে বললেন, সব প্রতিকূলতা মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে সবার আগে। দরিদ্র পরিবারে সিংহভাগ শিক্ষার্থীই হয়ে ওঠে এমনিতেই বোঝাস্বরূপ, লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকতে পারলে বোঝা লাঘব হয়। সেসব বিবেচনায় যত তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, ততই তাদের সবার জন্য কল্যাণের হবে। তবে তিনি দুঃখ করে আরেকটা কথা বলেছিলেন, ‘আমরা শিক্ষকেরাও যেন আমাদের দায়িত্ববোধের কথা প্রতিদিন ঝালাই করে নিই, সচেতন থাকি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত এ ধরনের সংকট নিরসনে আমাদেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে।’
বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সভ্যতার, আমাদের সংস্কৃতির শেষ দুর্গ। সেই ঐতিহ্য রক্ষা করতেই বোধ করি, শোনা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দল-মতনির্বিশেষে সব শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেবে। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেবে নিশ্চয়ই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্নপূরণের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থে সব ছাত্রসংগঠন, সাধারণ ছাত্ররা এবং শিক্ষকেরা যদি আন্তরিক হন, তাহলে অবশ্যই প্রাণপ্রিয় এই ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া সম্ভব। অন্যথায় কবিগুরুর সেই সতর্কবাণীই আমাদের পাথেয় হতে পারে—
‘অভ্যাসে, আমাদের বুদ্ধি বিকারে নিহিত আছে আমাদের সর্বনাশ।’
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com