বিশ্বায়নের কাল

বিচারের আগে দোষী একজন আদিলুর

আদিলুর রহমান খান
আদিলুর রহমান খান

প্রায় এক দশক পর গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরের বারান্দায় আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে সর্বজনীন পরিবীক্ষণের (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ) অধিবেশনগুলোর ফাঁকে বিরতির সময়। আদিলুর আমাকে বলছিলেন যে বাংলাদেশে গুম বলে কিছু নেই ঘোষণা দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, ‘কই, আমাকে অভিনন্দন জানাবেন না।’ আদিলুর তখন তাঁকে উল্টো দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। সরকার যেখানে আন্তর্জাতিক পরিসরে গুমের কথা স্বীকারই করে না, সেখানে আদিলুর এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘অধিকার’ প্রায় এক দশক ধরে মাসওয়ারি গুমসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের হিসাব প্রকাশ করে আসছে, আর তার পরও তিনি মুক্ত জীবনযাপন করবেন, সেটা আশা করা যে ঠিক নয়, তা এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে।
আদিলুর রহমানকে আমি চিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি যখন বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাসদের ছাত্রসংগঠনের মধ্যম সারির নেতা হিসেবে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতেন, তখন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে আদালত অঙ্গনে যাওয়ার পর তিনি আইনজীবীদের কথিত প্রগতিশীল গোষ্ঠীরই একজন ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে তিনি যাঁদের সঙ্গে ছিলেন, সেই সব সহযোদ্ধার অনেকেই এখন সুপ্রিম কোর্ট এবং এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারক অথবা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। কিন্তু কেন জানি আদিল একটু দলছুট হয়ে গেলেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের চাকরি নেওয়ায় আদিলুর রহমানকে তো আর প্রগতিশীল বলা যায় না। যদিও রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা পদে দলীয় সদস্যদের বাইরে যোগ্য ও দক্ষ আইনজীবীদের নিয়োগ করার দৃষ্টান্ত বিএনপি তার আগের আমলে রেখেছে। অবশ্য রাষ্ট্রের চাকরি করার সময়েও আদিল অধিকার-এর কার্যক্রমের সঙ্গে, অন্তত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জড়িত ছিলেন।
অথচ কী বিস্ময়ের কথা, অধিকার তখনো গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের হিসাব নিয়মিত প্রকাশ করেছে। ১০ আগস্ট পুলিশ আদিলুরকে যে ৫৪ ধারায় সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করেছে, সেই ৫৪ ধারার অপব্যবহারের হিসাব-নিকাশও তারা বছরের পর বছর প্রকাশ করেছে। ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ৩০ এপ্রিল সরকার পতনের ডেডলাইন ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গণধরপাকড়ে সাড়ে আট হাজার লোককে গ্রেপ্তারের যে তথ্য অধিকার প্রকাশ করেছিল, আদিলুরের গ্রেপ্তারের চার দিন পরও আমি দেখলাম তাদের ওয়েবসাইটে সেই তথ্য রয়েছে। ওই বছরে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে ৭৯ জন, পুলিশের হাতে ১২৮ জন এবং চিতা আর কোবরা নামের আরও দুটি নিরাপত্তা ইউনিটের হাতে মানুষ হত্যার বিবরণ রয়েছে সেখানে। সেই বছর পাঁচজন সাংবাদিক হত্যা এবং ১১১ জন নির্যাতিত হওয়ার তথ্যও সেখানে রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারের এসব তথ্য তখন নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অধিকার শুরুর কয়েক বছর খুব একটা কাজ দেখাতে পারেনি। সম্ভবত তখনো তারা সেই প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অর্জন করেনি। প্রথম দশকে তাদের কার্যক্রম অনেকটা সীমিত ছিল বলেই মনে হয়। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষণের পরিধিও অনেক সীমিত ছিল বলে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও সেই নির্বাচনের সময় সংঘটিত সহিংসতার কথা সেই প্রতিবেদনে আছে, যাতে ৫২ জনের প্রাণহানি এবং ৮৬৭ জনের আহত হওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতন, গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারাগারে মৃত্যু, রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত, সীমান্তে হত্যা, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা, ধর্ষণ, গণমাধ্যমের ওপর হামলার সংকলিত তথ্য অধিকার-এর ওয়েবসাইটে এখনো পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর প্রায় সব কটিতেই বছরওয়ারি হিসাবে বর্তমান সরকারের তুলনায় চারদলীয় জোট আমলে হতাহতের সংখ্যা বেশি বলে প্রমাণ মেলে। এগুলোর সবটাই একেবারে নির্ভুল অথবা রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত যদি না-ও হয়, তা হলেও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি এতটা বিশদভাবে আর কেউ তুলে ধরেছে বলে আমার চোখে পড়েনি। সম্ভবত সে কারণেই বিদেশিদের জন্য অধিকার-এর ওয়েবসাইট হাতের কাছে মজুত তথ্যভান্ডার হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে।
২০০৭-০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই পরিসংখ্যান প্রকাশের নিয়মে কোনো ছেদ পড়েনি। অধিকার-এর অন্যতম পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলানকে নৌবাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়ায় অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত সরব হয়েছিল এবং সেবারও বিদেশি কূটনীতিকেরা তাঁকে হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কিন্তু যেহেতু আদিলুর রহমান বিএনপি-জামায়াত সরকারের চাকরি করেছেন, সেহেতু তাঁর কোনো কাজ মহাজোট সরকারের বিপক্ষে গেলে তাঁকে জামায়াতি হিসেবে চিহ্নিত করাই তো সবচেয়ে সহজ কাজ। (যদিও গোলাম আযমের নাগরিকত্বের দাবিতে বিবৃতিদানকারী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।) আর সেই কাজটি করছি আমরা গণমাধ্যমের কেউ কেউ। তাঁকে জামায়াতি হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিদেশিদের এজেন্ট হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করা যায়। কেননা, তাঁর গ্রেপ্তারে বিদেশি কূটনীতিকেরা, এমনকি জাতিসংঘও যতটা দ্রুত এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, আমাদের কোনো শীর্ষ রাজনীতিকের ক্ষেত্রে ততটা দেখা যায়নি। গত ৫ মে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে অধিকার-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দিয়ে এবং ছবি সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃত করে দেশের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার যে অভিযোগ সরকার এনেছে, তা এতটাই গুরুতর যে অনেকের মতে সংক্ষিপ্ত বিচারের (সামারি ট্রায়াল) মাধ্যমে আদিলকে যত দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়, ততই ভালো। সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের তথ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তাঁদের চোখে পড়েনি, কেননা, মন্ত্রীর কথাকেই সত্য ধরে নেওয়া সহজ। আর মন্ত্রী বলেছেন, আপনি জামায়াতের এজেন্ট। যে মন্ত্রী এমনটি বলেছেন, তিনি আদিলুরের সাবেক নেতা। সুতরাং ওনার তো তাঁকে বেশি চেনার কথা। সুতরাং সংবাদমাধ্যমের প্রায় সবাই মেনে নিয়েছে যে আদিল হেফাজতিদের পক্ষ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের প্রচারণায় কণ্ঠ মিলিয়েছেন। এই ছাপ্পা লাগার কারণে ভবিষ্যতে জামায়াত অথবা সেটি নিষিদ্ধ থাকলে তাঁকে বিএনপিতে আশ্রয় নিতে দেখলেও আমি বিস্মিত হব না।
রাজনৈতিক আদর্শ, পেশাগত প্রতিযোগিতা এবং সুবিধাবাদ—এসব কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সব পেশাতেই আছে। সব দেশেও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিভাজন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে তাতে উদ্বিগ্ন বোধ না করে পারা যায় না। দলকানা এবং ফরমায়েশি সাংবাদিকতার কারণে এই পেশার মহত্ত্ব এবং সততার অবশিষ্টটাও আমরা খোয়াতে বসেছি বলে মনে হচ্ছে। আদিলুর রহমান খানের গ্রেপ্তার এবং তার পরের ঘটনাবলির খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্যগুলো পড়ে আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে, আমরা হয় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে, নয়তো ফরমায়েশ অনুযায়ী শুধু চলমান ঘটনাপ্রবাহের ধারাবর্ণনার মধ্যেই সাংবাদিকতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছি। অধিকার-এর কাজের ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা আমরা চিন্তাও করেছি বলে মনে হয় না। অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাঁকে আমরা অপরাধী বানিয়ে ফেলেছি।
যে ৫৪ ধারার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অধিকার এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছে, সেই ৫৪ ধারায় আদিলুরকে গ্রেপ্তার, পরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে পুলিশের মামলা এবং তথ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে কতটা সংগতি আর অসংগতি—এসব প্রশ্ন ছাড়াই অধিকার-এর সম্পাদককে দোষী ধরে নিয়ে আমরা নানা সংবাদ, বিবৃতি এবং বিশ্লেষণ প্রকাশ করছি। কেউ জানতে চায়নি যে তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও কেন তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হলো? অধিকার একটি এনজিও হিসেবে সরকারের এনজিও ব্যুরোতে রেজিস্ট্রিভুক্ত প্রতিষ্ঠান। যেকোনো এনজিওর অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর। তারা যেখানে নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয়, সেখানে তথ্য মন্ত্রণালয় অধিকার-এর কাছে তথ্য চাইল কেন? তথ্যপ্রযুক্তি আইনের লঙ্ঘন ঘটে থাকলে তা কি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা? তথ্যমন্ত্রী বলছেন যে তথ্য না দিয়ে ‘অধিকার’ দেশের তথ্য অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে। কেউ তথ্য অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে কি না, সেই রায় তো তথ্য কমিশনের দেওয়ার কথা। তাঁর মন্ত্রণালয় তো তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইতে গিয়েছিল বলে শুনিনি। সরকার এমনকি তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টেও যেতে পারত।
আশার কথা, আদিলুরের আদালতের সহকর্মীদের অধিকাংশই দলীয় অন্ধত্বের ঊর্ধ্বে উঠে একটি প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ হতে পেরেছে—এমনটি দাবি করার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না; বরং জাতিসংঘের বর্ণনায় একজন মানবাধিকাররক্ষীকে (হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার) আদালতের বিচারের আগেই দোষী সাব্যস্ত করায় একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি লজ্জিত এবং আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।