অনলাইনে নারীদেরই বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়
অনলাইনে নারীদেরই বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়

মতামত

বিকারগ্রস্ত চোখ কি নজরদারিতে সারে?

১৬ নভেম্বর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিএসএসডব্লিউ) ফেসবুক পেজ উদ্বোধন করা হয়। উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগী, বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফেসবুক পেজটি উদ্বোধনের পরের দুই দিন অর্থাৎ শুধু ১৭ ও ১৮ নভেম্বর এখানে ৬৯১টি অভিযোগ আসার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের তথ্যমতে, এই সেবা চালুর এক সপ্তাহের মধ্যে ১ হাজার ৯১৬ জন তাঁদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য যোগাযোগ করেছেন। সেবাপ্রার্থীদের সিংহভাগই কিশোরী ও তরুণী; যাঁদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার মাত্রা বুঝতে সম্প্রতি প্ল্যান-প্রথম আলো যে অনলাইন জরিপটি পরিচালনা করে, তাতেও বেরিয়ে এসেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি কখনো না কখনো অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশই নারী। এই নারীদের বেশির ভাগই আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীর প্রতি হয়রানির বিষয়টি নতুন কিছু নয়। পরিস্থিতি বর্তমানে এতটাই ভয়াবহ যে হয়রানির শিকার নারীর সংখ্যা যদি ৫৩ শতাংশ না হয়ে শতভাগও হয়, তবু অবাক হব না। আমার চেনা পরিসরে প্রায় প্রতিটি নারীরই এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা আমার জানা।


দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটির বেশি। এর ৮৬ শতাংশই মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। একই সঙ্গে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা। প্ল্যান-প্রথম আলো জরিপে অংশ নেওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ৯৯ শতাংশই ফেসবুক ব্যবহার করেন।
মনে পড়ে, ২০১৮ সালে ব্র্যাক ‘নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয় গণপরিবহন ব্যবহারকারী ৯৪ শতাংশ নারীই কখনো না কখনো গণপরিবহনে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

যেহেতু ইন্টারনেট এখন প্রায় প্রতিটি মুঠোফোনে পৌঁছে গেছে, তাই বলা যায় নারীদের হয়রানি করা সেই সব পুরুষের চোখ কিন্তু প্রতিমুহূর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে। আর সেই চোখগুলো মোবাইলের স্ক্রিনেও খুঁজে ফিরছে একই বিকৃত আনন্দ। বরং এই মাধ্যমে বিকৃত আনন্দ লাভ করা আরও সহজ ও নিরাপদ। কারণ এখানে নেই তেমন কোনো নজরদারি আর অপরাধীর প্রতি আইনের দৃশ্যমান প্রয়োগ। ফলে বেড়ে চলেছে সাইবার অপরাধ।

বর্তমান করোনা মহামারির বাস্তবতা যেন মানুষকে আরও বেশি ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার দায়বদ্ধতা মানুষকে অধিকতর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমমুখী করে তুলছে। তাই ঝুঁকি বাড়ছে। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই সংযোজিত হচ্ছে অভিনবত্ব আর রুচির বিকৃতি।

ব্র্যাকের সেই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রায় ৮১ শতাংশ নারী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হয়েও নীরব থেকেছেন। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ঘটনাই গোপন রয়ে যায়। একেবারে নিরুপায় না হলে নারীরা সাধারণত এই বিষয়ে মুখ খোলেন না। মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এগিয়ে পুরুষেরা। মোবাইল অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএম-এর ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য ৩৮ শতাংশ। ২০২০ সালেও এই অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নারীরা রয়েছেন অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে।

বর্তমান করোনা মহামারির বাস্তবতা যেন মানুষকে আরও বেশি ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার দায়বদ্ধতা মানুষকে অধিকতর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমমুখী করে তুলছে। তাই ঝুঁকি বাড়ছে। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই সংযোজিত হচ্ছে অভিনবত্ব আর রুচির বিকৃতি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ। সীমিত পরিসরে অনলাইনেই পরিচালিত হচ্ছে ক্লাস। সেখানে প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে হয়রানির ঝুঁকি। এমনকি শিক্ষকেরাও নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমনিতেই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে সবাই। তার ওপর অনলাইন ক্লাসে নিরাপত্তার ঝুঁকি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়কেই বিব্রত করছে। তাই প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিজের নিরাপত্তাসংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান। এ ক্ষেত্রে স্কুলগুলো বিষয়ভিত্তিক ক্লাসের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেশনের আয়োজন করতে পারে। এ দেশে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ নানা ধরনের আইন। দুর্ভাগ্য হলো এই সব আইনের অধীনে করা মামলার ক্ষেত্রেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা।

এ ছাড়া রয়েছে অনলাইনে হয়রানির শিকার হলে কীভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেই ধরনের জ্ঞানের অভাব। তাই প্রয়োজন সাহায্যপ্রার্থী পথগুলো সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জনগণকে জানানো। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগীরা দ্রুত সাহায্য লাভ করবেন, অন্যদিকে অপরাধীরাও একধরনের চাপে থাকবেন। প্রয়োজন অপরাধীর সাজাপ্রাপ্তির খবরগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোকে এ ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে নারীর প্রতি সংঘটিত সাইবার অপরাধ কমিয়ে আনতে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্যোগটি শুরু হয়েছে তা অক্ষুণ্ন থাকলে অনেক নারীই এর সুফল পাবেন।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে এই ইউনিটে ভুক্তভোগী নারীদের সেবার জন্য কাজ করছেন শুধু নারী পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে আমার মনে হয় এই ধরনের উদ্যোগে পুরুষ পুলিশ সদস্যদেরও সম্পৃক্ত করা জরুরি। নারীর সমস্যার সঙ্গে যত দিন পুরুষকে একীভূত করা না হবে, তত দিন এই ধরনের সমস্যাগুলো দূর হবে না। যেকোনো অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজন নারী-পুরুষ সবার সমান অংশীদারত্ব। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশ পুলিশ। এতে প্রসারিত হতে পারে পুরুষের ওপর হারিয়ে যাওয়া নারীর আস্থার জায়গাটুকুও।

তবে মনে রাখতে হবে, এই ধরনের অপরাধ নারীর প্রতি বেশি মাত্রায় সংঘটিত হলেও পুরুষেরাও কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নন। পুরুষেরাও যেন তাঁদের প্রতি এই ধরনের হয়রানিতে সহযোগিতা পান, সে ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। একদিকে যেমন নির্যাতকদের প্রতিরোধে প্রয়োজন নৈতিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা; অন্যদিকে প্রয়োজন কেউ যেন প্রতারকের পাতা ফাঁদে পা না দিতে পারেন, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান। যেকোনো মাধ্যমে ছবি, ভিডিও কিংবা তথ্য আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে সংযম এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা খুব জরুরি। সর্বোপরি জানতে হবে বিভিন্ন সম্পর্কের সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য এবং এর সীমারেখা। এ ছাড়া প্রয়োজন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারার তীব্র বাসনা।


নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com