বিএনপি কি এখন রাজনীতি করছে?

জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া
জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া

প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরের মাথায় কেমন আছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি? সার্বিক বিষয়াদি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দিশাহীন, এলোমেলো সময় পার করছে দলটি। অগোছালো রাজনীতির ভারে ডুবে গেছে বিএনপি। কখন কী করবে, দলটির কে কী বলবে, বোঝা মুশকিল। বুদ্ধিদীপ্ত, গঠনমূলক রাজনীতি থেকে বিএনপির অবস্থান যোজন যোজন দূরে।

শুরুর দিকের বিএনপির সঙ্গে বর্তমানের বিএনপির আকাশ-পাতাল তফাত। ওই সময়ের বিএনপি রাজনীতিতে ছিল ক্ষিপ্র, দ্রুতগামী, চমকে ভরপুর। বিএনপিকে দেখে এখন মনে হয় বার্ধক্যে ভুগছে। দলটির বসন্ত এখন অতীত। শীতের রুক্ষতার পাতা ঝরার দিনে আছে বিএনপি। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় লাগে দলটির। দোনোমনা ভাব স্পষ্ট। অহেতুক পরিস্থিতিকে জটিল করে ফেলে। সহজ, সরলভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ যেন পেয়েছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, লক্ষ্যহীন এক পথের যাত্রী দলটি। যে পথের কোনো উদ্দেশ্য নেই, শেষও নেই। এ কারণেই দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেই সংসদে গেলেন বিএনপির সদস্যরা। গেলেন তো গেলেন, কিন্তু সংসদে এমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি, যা বিএনপির জন্য  ইতিবাচক হতে পারে। বরং বিএনপির এক সদস্য সংসদে বলছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃপায় তিনি সংসদে প্রবেশ করতে পেরেছেন। আরেক সাংসদ তাঁর বক্তব্যে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। কী ভয়ংকর অবস্থা!

একজন বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ বিএনপি দিনভর ক্রসফায়ার ও বিনা বিচারে হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে। বিএনপির কতশত নেতা-কর্মী ক্রসফায়ার, গুমের শিকার হয়েছেন, তার হিসাব ওই সাংসদের কাছেও হয়তো নেই। অথবা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি প্রশ্নবিদ্ধ এক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে যেতে পেরে ও সরকারি ভাতা পেয়েই খুশিতে গদগদ।

৪২ বছরের মূল্যায়নের দেখা যাচ্ছে, বিএনপি সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারেনি। ১৪ বছর দলটি ক্ষমতায় নেই। এ সময়ে অনেক নতুন নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। রাজনীতি নিয়ে এঁদের অনেকেই এখন খোঁজখবর রাখেন। এঁদের সামনে বিএনপি নিজেদের নতুনভাবে তুলে ধরতে পারেনি।

বিএনপির সাংসদদের বালখিল্য আচরণ যে জনমনে যথেষ্ট হাস্যরসের সৃষ্টি করছে, তা বিএনপির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন কি? বিএনপি দলীয়ভাবে নেতা-কর্মীদের জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। এ কারণেই নেতা-কর্মীরা কখনো একই সুরে কথা বলেন না বা বলতে পারেন না। এটা হচ্ছে বিএনপির রাজনীতির বড় দুর্বলতা। তবে বিএনপি দাবি করতে পারে, এটা তাদের রাজনৈতিক উদারতা। নেতা-কর্মীদের চিন্তা বা বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে না।

বিএনপির এলোমেলো রাজনীতির অনেক উদাহরণ আছে। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই না, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেলাতেও বিএনপি একই ধরনের আচরণ করেছে। বহির্বিশ্বে যারা বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, তারা বিএনপি থেকে এখন অনেক দূরে। একসময়ের মিত্র চীন আর বিএনপির খুব একটা ঘনিষ্ঠ বলে মনে হয় না। চীন কেন দূরে গেল? বরং বলা ভালো, বিএনপিই চীনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে যে তালগোল পাকিয়েছে, তার খেসারত এখনো বিএনপিকে দিতে হচ্ছে। কারা চীনকে এড়িয়ে তাইওয়ানকে গুরুত্ব দিল, বিএনপি কখনো বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে বা অনুসন্ধান করেছে বলে মনে হয় না।

বড় সমস্যা হচ্ছে বিএনপি নিজের রাজনীতিটা করতে পারছে না। বিএনপি একটি বড় দল। জনসমর্থন আছে, ভোটারও আছে। স্বভাবতই নাগরিকেরা দলটির কাছে গোছানো ও পরিকল্পিত রাজনীতি আশা করে। মনে করে বড় দল হিসেবে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে থাকবে বিএনপি। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপি এখন পর্যন্ত কী করেছে যে বিএনপিকে জনসাধারণ আস্থায় নেবে? গণতন্ত্রের লড়াই মানেই জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন না। সময়োপযোগী নানা কর্মসূচি দিয়েও দাবি আদায় করা যায়, জনগণকে আকৃষ্ট করা যায়। বেলারুশে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে লাখো মানুষ পথে নেমেছে। সেখানে জ্বালাও-পোড়াও হয়নি। প্রতিদিনই মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিএনপির মিছিলে সেই শান্তিপূর্ণ মানুষ কই।

প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরেও বিএনপি সুগঠিত সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি। কমিটি গঠন ও কোন্দল নিয়ে এত সময় ব্যয় করে দলটি যে রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় পায় না। একটি ইউনিটের কমিটি করতে মাসের পর মাস সময় নষ্ট করে। কর্মীরা রাজপথ বাদ দিয়ে নেতাদের বাড়িতে বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তদবির করে পদ পাওয়ার জন্য। এখন নেতাদের পিছু পিছু ঘোরাই বিএনপির কর্মীদের দৈনন্দিন রাজনীতি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠন করাই বিএনপির প্রধান ও একমাত্র কাজ। সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিএনপির উপস্থিতি তো বলতে গেলে নেই।

৪২ বছরের মূল্যায়নের দেখা যাচ্ছে, বিএনপি সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারেনি। ১৪ বছর দলটি ক্ষমতায় নেই। এ সময়ে অনেক নতুন নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। রাজনীতি নিয়ে এঁদের অনেকেই এখন খোঁজখবর রাখেন। এঁদের সামনে বিএনপি নিজেদের নতুনভাবে তুলে ধরতে পারেনি। নিজেদের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, গুম, ক্রসফায়ারের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফলভাবে তুলে ধরতে পারেনি।

বিএনপির ব্যর্থতা দেশের রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। বড় দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় প্রতিপক্ষ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে বসেছে। এ অবস্থায় নতুন রাজনীতিও নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বিএনপি সম্পর্কে জনসাধারণের একটা অংশ এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দলটি টিকে থাকবে, না রাজনীতির চোরাস্রোতে হারিয়ে যাবে, সে বিষয়ে অনেকে নিশ্চিত না।

প্রতিপক্ষ যেভাবে চায়, জেনে বা না-জেনে বিএনপি সেভাবেই আচরণ করে। যেমন বিএনপি আবারও উপনির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে কী হবে, সবাই জানে। এরপরও বিএনপি উপনির্বাচনে যাবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির যুক্তি হচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে অনিয়ম প্রমাণ করা হবে। রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী একবার মরে প্রমাণ করেছিল সে মরে নাই। আর বিএনপি বারবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রমাণ করছে নির্বাচনে অনিয়ম আছে। নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি জনসাধারণ ধরে ফেলেছে। তাই ভোটকেন্দ্রে এখন আর কেউ যায় না। কিন্তু বিএনপি বুঝতে পারছে না। তাই বারবার উপনির্বাচনে যাচ্ছে।

উদভ্রান্ত আচরণ বাদ দিয়ে বিএনপির এখন পেছন ফিরে দেখা উচিত। চার দশক একেবারে কম সময় না। এই সময়ের মধ্যে দল হিসেবে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকা উচিত ছিল বিএনপির। বিএনপি নেতা-কর্মীরা কখনো কি পেছন ফিরে তাকিয়ে নিজেদের অতীতটাকে দেখেন? জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটির সঙ্গে বর্তমানের কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পান? জিয়াউর রহমান যে ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেই পাটাতন যে একটু একটু করে খসে পড়ছে, তা টের পান? ওই সময়ের বিএনপি যে নতুনত্বের দিশা ও নতুন রাজনীতি দিয়েছিল, তা কি বর্তমানের বিএনপি অনুসরণ করতে পারছে?

নিজের জন্য বোঝা হয়ে ওঠার আগে বিএনপির আত্মানুসন্ধান জরুরি।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক