খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ, তিনি তাঁর আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করেছেন। আন্দোলনের পাশাপাশি সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেটাও প্রশংসাযোগ্য। দেখা যাক নতুন কৌশল নিয়ে তিনি কত দূর এগোতে পারেন। আশা করি খালেদা জিয়া, বিএনপি বা ১৮-দলীয় জোট এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে ৫ জানুয়ারি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করা আরও কঠিন কাজ হবে। নির্বাচন যতই প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের হোক না কেন, বাস্তব সত্য হলো: একটা নির্বাচন হয়েছে। ১৪-দলীয় জোট নতুন সরকার গঠন করেছে। এটা বাস্তব। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই বিএনপিকে নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলা যাবে না, জনসমর্থিতও বলা যাবে না। এটা নিয়ম রক্ষার প্রশ্নবিদ্ধ সরকার।
বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় দল। তবে গত এক বছরে প্রমাণিত হয়েছে বিএনপি লড়াকু দল নয়। বিএনপির সামনে এখন বড় সংকট। জানি না বিএনপি এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে। লেখার শুরুতেই বিএনপির কিছু সাফল্যের কথা তুলে ধরতে চাই। সাম্প্র্রতিককালে টিভি টক শো ও সংবাদপত্রে বিএনপির নানা সমালোচনা হচ্ছে, যা সব সময় পুরোপুরি ন্যায্য নয়। সমালোচকেরা আংশিক বর্ণনা করেন, যা অনুচিত। যেসব কথা মিডিয়ায় সে রকমভাবে আসেনি। তা হলো—১. ঢাকায় ব্যর্থ হলেও বিভিন্ন জেলা শহরে বিএনপি ও ১৮-দলীয় জোট ভালোভাবেই আন্দোলন করেছে। হরতাল ও অবরোধ প্রায় সব জেলায়ই সফল হয়েছে। ২. আওয়ামী লীগের সরকার নানা চেষ্টা করার পরও ৩০০ আসনের একটিতেও বিএনপির কাউকে দিয়ে নির্বাচন করাতে পারেনি। সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। এটা একটা দলের জন্য কম কৃতিত্ব নয়। ৩. নির্বাচন কমিশন চক্রান্ত করে ‘বিএনএফ’ নামে একটি ভুয়া দল সৃষ্টি করলেও বিএনপির একজন নেতাও ওই দলে যোগ দেননি। সরকারের ‘বিএনএফ’ পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়েছে। ৪. ১৮-দলীয় জোটের আন্দোলনের ফলেই সরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারেনি। সরকার যদি আগামী পাঁচ বছরও ক্ষমতায় থাকে, তবু এক দিনের জন্যও এই কলঙ্ক মোচন হবে না। ৫. সরকার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে এবার ভালোভাবে প্রমাণ করেছে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এটাও বিএনপির বিজয়।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে আন্দোলনের একটা অধ্যায় বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে যাওয়ার আগে বিএনপির প্রথম কাজ হবে আত্মসমালোচনা করা (যা কেউ করতে চায় না)। আত্মসমালোচনা না করলে বিএনপি তার ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারবে না। বলাবাহুল্য, বিএনপি গত আন্দোলনে প্রচুর ভুল করেছে। প্রথমে ভুলগুলো স্বীকার করতে হবে। ভুল স্বীকার করলেই পরবর্তী পদক্ষেপগুলো মোটামুটি ঠিকভাবে নিতে পারবে। ভুলগুলো প্রচারের জন্য নয়। নিজেদের অবস্থান বোঝার জন্য খুব জরুরি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমরা বিএনপির কী কী ভুল দেখেছি? ১. বিএনপি ঢাকা শহরে তার শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিল না। ঢাকায় বিএনপির অন্তত পাঁচ হাজার লড়াকু কর্মী নেই। ২. দলের শীর্ষস্থানীয় ১০ জন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলটি কাবু হয়ে গেছে। ৩. কারারুদ্ধ সাদেক হোসেন খোকা ছাড়া ঢাকায় আন্দোলন সংগঠিত করার মতো আর যোগ্য নেতা নেই। ৪. কেন্দ্রের বেশির ভাগ নেতাই আন্দোলনমুখী নন, মিডিয়ামুখী। বেশির ভাগই বুদ্ধিজীবী টাইপের নেতা। একটি বড় দলে অন্তত ৫০ জন আন্দোলনমুখী নেতা ও পাঁচ হাজার আন্দোলনমুখী কর্মী থাকতে হয়, যাঁরা জান বাজি রেখে দলের কর্মসূচি রাজপথে বাস্তবায়ন করতে পারেন। গত তিন মাসের আন্দোলনে দেখা গেছে বিএনপিতে সেই রকম নেতা ও কর্মী খুব কম। নয়াপল্টনের জনসভায় যোগ দেওয়া, মিছিল করা, সেমিনার করা আর জান বাজি রেখে রাজপথে আন্দোলন করা এক কথা নয়। ৫. বিএনপি একটি পেটিবুর্জোয়া সনাতন রাজনৈতিক দল। বিপ্লবী দল নয়। কাজেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াবেন, তা সমর্থনযোগ্য নয়। দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হবেন, এটাই স্বাভাবিক। গ্রেপ্তার হলে তো বড় নেতা হওয়া যায়। রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার হওয়া রাজনৈতিক নেতার একটা শর্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে বারবার গ্রেপ্তার না হলে এত বড় নেতা হতে পারতেন কি? ৬. নির্বাচন একবার করে ফেলতে পারলে আওয়ামী লীগকে টলানো কঠিন হবে। নির্বাচন প্রতিহত (বানচাল) করার মতো শক্তি বিএনপির নেই। নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য ঢাকায় ও অন্যত্র আইনানুগভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ থাকবে। তাদের পরাস্ত করে নির্বাচন প্রতিহত করতে হবে। এটা কত বড় লড়াই তা বিএনপির হাইকমান্ড অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ৭. গত তিন মাসের আন্দোলনে বিএনপি তার নেতা ও কর্মীর বাইরে (সব নেতা ও কর্মীও রাজপথে ছিলেন না) সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। কোথায় ছিল তাদের যুবদল ও ছাত্রদল? (কয়েকজন অবশ্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আগেই) বেশির ভাগ নেতাই স্লোগান, মিছিল ও জনসভার লোক। আন্দোলনের লোক খুব কম। অনেক নেতাই সুবিধাবাদী। সুসময়ের বন্ধু। এটা এবার প্রমাণিত হয়েছে। তবে একটা কথা সবার বুঝতে হবে, আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা এখন খুব সহজ কাজ নয়। ’৬৮-৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতার আন্দোলন বা ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতো ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা এখন প্রায় অসম্ভব। তবু এখনো কিছুটা সম্ভব হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইস্যু হলে বা ধর্মবিষয়ক কোনো ইস্যু হলে। ৮. ১৮-দলীয় জোটের আন্দোলনে যে ব্যাপক সন্ত্রাস ও সহিংসতা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ সমর্থন করেননি। এসব হিংসাত্মক ঘটনায় ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানিতে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এতে লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের। জনগণের ক্ষোভ ও সমালোচনাকে তারা ক্যাশ করেছে। ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। খালেদা জিয়া যতই বলুন, ‘সহিংসতা বিএনপি করেনি’, তা বাস্তবতার ধোপে টেকেনি। সন্ত্রাস ও সহিংসতা দিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি, উল্টো বিএনপির বদনাম হয়েছে। আন্দোলনে সন্ত্রাস ও সহিংসতা পুরো আন্দোলন সম্পর্কেই দেশে-বিদেশে একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে, তা বিএনপি আগে বুঝতে পারেনি।
এগুলো আমাদের প্রধান পর্যবেক্ষণ। এর বাইরে হয়তো আরও অনেক বিষয় থাকতে পারে। বিএনপির নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতাও থাকতে পারে। নিঃসন্দেহে তা হবে খুব মূল্যবান।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে বিএনপি কী করবে, কী কৌশল নেবে, তা আমরা বিস্তারিত জানি না। তবে সরকার তথা আওয়ামী লীগ এখন অনেক শক্তিশালী। প্রহসনের নির্বাচনের কলঙ্ককে তারা গায়ে মাখছে না। আমাদের ধারণা, সরকার সংলাপের নাটক করবে কিন্তু অর্থবহ সংলাপ করবে না। সংলাপ করলেও আওয়ামী লীগ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ মানবে না। আওয়ামী লীগ এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যার মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে ও জয়লাভ করার সুযোগ পাবে। নির্বাচন থেকে যেকোনোভাবে বিএনপিকে দূরে রাখাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলে আমরা খুশি হব। তবে এই ধারণাগুলো বিএনপিকে মনে রাখতে অনুরোধ জানাই।
২০১৪ সালটা বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরেই যা কিছু করার বিএনপিকে করতে হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, দেশি-বিদেশি চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা। এই বছরটি যদি সরকার নানা টালবাহানায় পার করে দিতে পারে, আমাদের ধারণা, পরিস্থিতি আর বিএনপির অনুকূলে না-ও থাকতে পারে।
বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, আইনি প্রক্রিয়ায় জামায়াত নিষিদ্ধও হয়ে যেতে পারে। ভোটের কিছু শেয়ার ছাড়া বিএনপির জন্য জামায়াত তেমন প্রয়োজনীয় দল নয়। তা ছাড়া জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার, সন্ত্রাসী দল ইত্যাদি অভিযোগও রয়েছে। এ রকম বিতর্কিত একটি দলকে সঙ্গে না রাখলে বিএনপির কি খুব বড় রকম ক্ষতি হবে? আমাদের ধারণা, না, তেমন বড় কোনো ক্ষতি হবে না। জামায়াতকে ছাড়লেও জামায়াতের ভোট বিএনপিই পাবে। জামায়াতকে বাদ দিলে বিএনপি আরও অন্তত তিন-চারটি দলকে আন্দোলনে পাশে পাবে, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকাও রাখতে পারবে। নতুন কয়েকটি দল ছাড়াও ব্যাপকসংখ্যক প্রগতিশীল মানুষও বিএনপিকে সমর্থন দিতে পারে, এমনকি ভোটের অধিকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে রাজপথেও নামতে পারে। জামায়াতমুক্ত বিএনপি নতুন তিন-চারটি দলের সহায়তায় ‘তত্ত্বাবধায়ক’ ইস্যুতে একটা বড় গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে, জামায়াতের সহায়তায় যে সহিংস আন্দোলন সমপ্রতি হয়েছে, তাতে দলের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বরং বিএনপি ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে জিয়াউর রহমানের বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পাথেয় করে একটা বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আন্দোলন শুরু করার আগে বিএনপিকে তার মিত্র, জোট, কৌশল, আন্দোলনের চরিত্র, কর্মসূচি ইত্যাদি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি বিএনপি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বিএনপির জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। বিএনপি ও খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই সেটি চান না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।