গড়পড়তা হিসাবে নমুনা পরিসংখ্যান যে বিদ্যমান বাস্তবতার নির্দেশনা দিতে পারে, তা বিজ্ঞানসম্মত সত্য। অবশ্য তা নির্ভর করছে উদ্যোক্তা বা পরিসংখ্যান গ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য, নৈর্ব্যক্তিকতা, নিঃস্বার্থতা ও দক্ষতার ওপর। বিভিন্ন কারণে পরিসংখ্যান গ্রহণ বা জনমত জরিপ নীতিনির্ধারণে ও সরকারি কর্মসম্পাদনে প্রয়োজনীয় বা অভিপ্রেত হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় জনমত যাচাই সরকারকে নিঃসন্দেহে সঠিক পথ অবলম্বনে সহায়ক হতে পারে, যদি সরকারের সে সদিচ্ছা থাকে। বিরোধী দলগুলো সত্য অনুধাবন করে তাদের গৃহীত নীতির বা কর্মকাণ্ডের পুনর্বিবেচনা করতে পারে। নিঃসন্দেহে জনমত জরিপ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি ঈপ্সিত অঙ্গ। অপরিহার্য উপাদান বললেও অত্যুক্তি হবে না।
প্রথম আলো ১০ অক্টোবর একটি জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে। নিয়মিত কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় মহাজোট সরকারের আমলে এটা তাদের ষষ্ঠ উদ্যোগ। তাদের এই প্রচেষ্টা যে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা সর্বজনস্বীকৃত। একটি সুপরিচিত পেশাদারি জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের কার্যক্রমে পরীক্ষিত দক্ষতা এবং পরিশীলিত পেশাদারি রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তাই বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই জনমত জরিপকে সংশ্লিষ্ট সবারই গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা উচিত—রাজনৈতিক দলগুলোর তো বটেই।
১০ তারিখ সকালবেলায় বিএনপির একজন সুপরিচিত নেতা আমাকে ফোন করে বললেন, দেখেছেন, প্রথম আলোর জরিপ? বিএনপিকে নাকি দেশের মাত্র ৫০.৩ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে চায়? তাঁর বক্তব্য, এটা তো মনে হচ্ছে অনেক কম। অন্তত ৭০ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। যা হোক, রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে দেখা গেল, হ্যাঁ, পরিসংখ্যানটি বাস্তবতানির্দেশক হতে পারে, কেননা সরকারের বা সরকারি দলের বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রমের বিরোধিতা ৮০ শতাংশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ মানুষ করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে ওঁরা সবাই যে বিএনপিকেই ভোট দেবেন, এমনটি ধরে নেওয়া সংগত হবে না। বিরোধীদের মধ্যে অন্য দল ও মতের লোক রয়েছেন, ইস্যুভিত্তিক বিরোধীরাও রয়েছেন। যেমন: নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন প্রথম আলোর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূর্ববর্তী এক জরিপে ৯০ শতাংশ মানুষ চান বলে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান জরিপেও তা শতকরা ৮২ ভাগ। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা তো মাত্র ১০ শতাংশ নন, তাই যেসব আওয়ামী সমর্থক এপ্রিল ২০১৩-এর জরিপে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ হয়তোবা বিভিন্ন কারণে দলীয় সমর্থন জাহির করেছেন। তবে এটা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য যে দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষমতা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নেই। আর দেশের ৯৩ শতাংশ লোক মনে করেন বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো সাধারণ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটি জরিপের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সত্য নির্ধারণ।
আমার কাছে মনে হয় এই জরিপের গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন সবাই তাদের নীতি ও কার্যক্রম নিরীক্ষণ এবং প্রয়োজনবোধে পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। এটা অনস্বীকার্য যে বিএনপির জনপ্রিয়তায় ঊর্ধ্বগতি রয়েছে এবং বর্তমানে দেশের অধিকাংশ লোক (শতাংশের প্রশ্ন বাদই দিলাম) বিএনপিকে ভোটদানে প্রত্যাশী। এই প্রবণতা বা গণসমর্থন জিইয়ে রাখতে হলে বিএনপির প্রয়োজন হবে স্বীয় নীতি-কর্ম নিরীক্ষণ এবং গণপ্রত্যাশা নির্ণয়।
বিশেষ করে, যেসব কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনে ধস নেমেছে, সেসব দর্শনীয়ভাবে ত্যাগ করা বা ক্ষমতাসীন হলে সেগুলো পরিত্যাগ করার দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন। আওয়ামী শাসনের প্রধান ঋণাত্মক ও দুর্বলতম দিক হচ্ছে সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব। প্রশাসনের দলীয়করণ জন্ম দিয়েছে অভাবিত টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের দৌরাত্ম্য, প্রতিহিংসা-বিচারবহির্ভূত খুন, গুম ইত্যাদির। বিএনপিকে কথায় ও কাজে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা এই ধিক্কৃত ও জননিন্দিত পথ গ্রহণ করবে না। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ পরিহার করবে। নির্বাচনকালীন প্রার্থী মনোনয়নে এটা অনেকটাই পরস্ফুিট হবে। অতএব, প্রথম থেকেই সাবধান। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অনুকূল নীতি গ্রহণ ও প্রয়োগ করা। এটা অনস্বীকার্য যে আজ দেশের সীমান্তে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশসংক্রান্ত স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। এই আত্মবিধ্বংসী নীতি পরিহার করে দেশ ও জাতির স্বার্থের অনুকূল কার্যক্রম গ্রহণে দৃঢ়চিত্ততা দেখাতে হবে বিএনপিকে।
দেশের উন্নয়নকল্পে, দুর্নীতি প্রতিরোধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কী জাতীয় নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে, বিএনপিকে তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করতে হবে। দেশ থেকে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতার রাজনীতি যে পরিহার করা হবে, সে ব্যাপারে প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকারের।
এসব ব্যাপারে মনোযোগী হলে জরিপে বিবৃত তথ্য মোতাবেক বিএনপির জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বগতি এবং অধিকতর ভোটপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকবে।
আরেক দিকে এই ধারাবাহিক জরিপগুলো থেকে আওয়ামী লীগ আত্মশুদ্ধির সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাবে। যদিও দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রত্যাশিত ভোট প্রদানকারীর সংখ্যা ২০১২ সালের ৩৪.৮ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ৩৬.৫ শতাংশে এসেছে, তবু তা বিএনপির ঊর্ধ্বগতি থেকে অনেক কম। ২০১২ সালের ৪৩.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৩ সালে তা ৫০.৩ শতাংশ হয়েছে। এটা জানা কথা সে এ ধরনের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে ভোটের সময়ে একটা গণজোয়ার সৃষ্টির প্রভূত সম্ভাবনা থাকে, যা এই জাতীয় সমর্থনকে আরও অনেক জোরদার ও ব্যাপকতর করে তোলে। পাঁচটি সিটি নির্বাচন এবং সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও দেশের ৮২ শতাংশ মানুষ চান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার এবং শতকরা ৯৩ শতাংশ মনে করেন বিএনপিবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং তাদের একদলীয় বা তথাকথিত সংশোধিত সাংবিধানিক নির্বাচন যে গণবিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক হবে, এটা তাদের বোঝা প্রয়োজন।
জরিপের প্রতিটি বিষয়ে যেমন সরকার পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষণ, দুর্নীতি, দলীয়করণ, আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনসমূহের কার্যক্রম, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ—প্রতিটি বিষয়েই সরকারি দলের প্রতি গণসমর্থন ও আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এখানে লক্ষণীয় যে যদিও জরিপমতে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তির দাবি করছেন, শতকরা ৫৯ ভাগ মানুষের বিবেচনায় বিচার-প্রক্রিয়া ঠিকভাবে চলছে না। এমনকি ‘বিচার চাই’র সমর্থক সংখ্যা ২০০৯-এর ৮৬ শতাংশ থেকে নেমে ৮০ শতাংশে চলে এসেছে। রায়-পরবর্তী সহিংসতা এবং জামায়াতের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি ৮৬ শতাংশ মানুষের (অর্থাৎ প্রায় সব দলের লোকেরই) বিরোধিতা এবং অসমর্থন থাকলেও জামায়াত নিষিদ্ধকরণের বিপক্ষে জনমত এপ্রিল ২০১৩-এর ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে অক্টোবর ২০১৩ সালে ৭০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে জনগণের ৬৩ শতাংশ যে সন্তুষ্ট নন (অর্থাৎ অধিকাংশ জনগণ) তা পরস্ফুিট এবং তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব ক্রমে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ জনমনে সন্ত্রাসীর প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে মহান ব্যক্তি বাঙালির শতাব্দীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে এসেছেন, সেই নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ক্রমবর্ধমানভাবে বর্তমানে দেশের ১০ জনের মধ্যে সাতজনই অগ্রহণযোগ্য বলে নাকচ করছেন। এসব বিষয়ে সরকার ও সরকারি দল ইতিবাচক দৃঢ় পদক্ষেপ না নিতে পারলে তাদের অধোগতি একটি চরম দুরবস্থায় নিয়ে যাবে।
জরিপের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নির্দেশক রয়েছে। যেমন তরুণদের এবং নারীদের মধ্যে বিএনপির জনসমর্থন তুলনামূলকভাবে বেশি। ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে জনমতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের চেয়ে তারেক রহমান ক্রমবর্ধমানভাবেই অনেক এগিয়ে। সজীব ওয়াজেদের ৫৩ শতাংশ সমর্থনের বিপরীতে ৫৯ শতাংশ জনগণ মনে করেন তারেক রহমান দেশে ফিরে রাজনীতি শুরু করলে তা দেশের জন্য ভালো হবে। এটা বিএনপির জন্য একটি বড় প্লাস পয়েন্ট। আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য নির্দেশক হলো, জাতীয় পার্টির প্রতি সমর্থন কয়েক মাসে ১১.৮ শতাংশ থেকে নেমে ৭ শতাংশে এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সমর্থন ৩.২ শতাংশ থেকে মাত্র ২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রধান দুটি দল তাদের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারে।
বস্তুত পক্ষে এই ধারাবাহিক পেশাদারি জরিপগুলো দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির বিষয়ে বিবর্তনমান বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘জনমত জরিপ থেকে প্রত্যাশা’ শীর্ষক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধের একটি মন্তব্যের সঙ্গে মতৈক্য পোষণ করে তা উদ্ধৃত করে আমার বক্তব্যের উপসংহার টানতে চাই, ‘নির্মোহভাবে দেখলে এই মতামত জরিপ থেকে দুই প্রধান দলই লাভবান হতে পারে। তাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের ওপরই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।’
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।