মতিঝিলের একটি ব্যাংকে গ্রাহকদের লেনদেন
মতিঝিলের একটি ব্যাংকে গ্রাহকদের লেনদেন

বাণিজ্যিক ব্যাংক সব নয়, বিকল্প জরুরি

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ অন্যান্য আমানত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর অবদান রাখতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিস্তারই শেষ কথা নয়। অন্যান্য ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা ও তার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তি ও সেবাদান সম্ভব।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা অপরিসীম। বৃহত্তর অর্থ ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। বিধিবদ্ধভাবে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারে এ রকম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধরন খুব বেশি নয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাইরে সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন, সেভিংস ব্যাংক এবং ক্রেডিট ইউনিয়ন, সব মিলিয়ে এই চার ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানই মূলত বিধিবদ্ধ আমানত সংগ্রহকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এই চার ধরনের বিধিবদ্ধ আমানত সংগ্রহকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বাণিজ্যিক ব্যাংকই প্রধান। বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রকারভেদ, আমানত সংগ্রহের ব্যাপ্তি, ঋণদান সক্ষমতা, ঝুঁকি বহনের মাত্রা, সঞ্চিতি, তারল্য ও মূলধন ইত্যাদি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের অবস্থান অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভালো। কিছু কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক শুধু রিটেইল বা খুচরা ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যাংকিংয়ে ব্যাংকিং লেনদেনের সংখ্যা বেশি হলেও লেনদেনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক শুধু করপোরেট কাস্টমারদের সেবা দিয়ে থাকে। করপোরেট বাণিজ্যিক ব্যাংকে লেনদেনের সংখ্যা তুলনামূলক কম হতে পারে কিন্তু লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৯ সালে গ্রাম-লিচ-বিলেলি আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের ধরন, মাত্রা ও পরিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ওই আইন প্রবর্তনের ফলে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক মার্চেন্ট ও বিনিয়োগ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়। স্বতন্ত্র বা একীভূত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একই সঙ্গে রিটেইল, করপোরেট, মার্চেন্ট, বিনিয়োগসহ বহুমুখী ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকে।
আজ থেকে প্রায় এক শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এখনকার তুলনায় তিন গুণের বেশি ব্যাংক ছিল। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত বৈশ্বিক মহামন্দাকালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৮-২০১০ সময়কালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের ফলে ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজারে নেমে আসে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক ও সেভিংস ব্যাংকের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। অর্থনৈতিক মন্দা, বহুমুখী নিয়ন্ত্রণ ও অতি প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণেই আমেরিকায় ব্যাংকের সংখ্যা কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক

বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন বিশেষায়িত ডিপোজিটরি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন হোম লোন মর্টগেজ ফাইন্যান্সে বিশেষভাবে পারদর্শী। তুলনামূলকভাবে যুবসমাজ খদ্দেরদের তারা টার্গেট করে। উন্নত দেশের অর্থনীতিতে বেকার সমস্যা তেমন প্রকট নয়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই, বিশেষত গ্র্যাজুয়েশনের শেষ বর্ষে এসে ছাত্রছাত্রীরা চাকরি খোঁজে। সম্ভাব্য নিয়োগদাতা কার্যকর অর্থেই নিয়োগপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করে। তেমন কোনো জটিলতা না থাকলে প্রায় সবাই চাকরি পেয়ে যায়।
উন্নত দেশগুলোয় চাকরির শুরুতে বেতন সবারই সমান বা কাছাকাছি হয়ে থাকে। নতুন চাকরি পাওয়া তরুণ–তরুণীরা যারা শিক্ষা ঋণ নিয়ে লেখাপড়া করেছে, প্রথমেই তা পরিশোধ করে। পরবর্তী সময়ে সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন এই সব নতুন এবং তরুণ জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে থাকে। তারা সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশনে বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ সঞ্চয় করে ভবিষ্যতে তাদের আকাঙ্ক্ষিত হোম লোন মর্টগেজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কাঙ্ক্ষিত সঞ্চয় জমা হলে কাস্টমারদের পক্ষ হয়ে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। কেনা বাড়ি ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত জামানত হিসেবে থাকে। ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনের তথ্যমতে, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫০০–এর কিছু বেশি, যা ২০১৯ সালে এসে ৬৫৯ তে দাঁড়ায়।

ক্রেডিট ইউনিয়ন বা ঋণদান সমিতি একটি জনপ্রিয় ডিপোজিটরি ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন। এটি মালিকানার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। মালিক বা সদস্যরা ক্রেডিট ইউনিয়নে সঞ্চয় জমা করেন এবং ঋণ গ্রহণে প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। আইবিআইএস ওয়ার্ল্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট ইউনিয়নের সংখ্যাও ক্রমেই কমছে। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে এর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ৮০০। এখন প্রায় ৫ হাজার ১০০। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট ইউনিয়নের ব্যবসায়িক গড় প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণাত্মক।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির কথা বেশ আলোচিত। অর্থনীতির সেবা ও পরিষেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোই এর মূল লক্ষ। তা সহজে করা যায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তার এবং বিস্তৃত সেবা প্রদানের মাধ্যমে।
আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থাই প্রধানতম আর্থিক সেবা ও পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ৬০টি চালু তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। প্রথাগত ও ইসলামিক, দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন এসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের সেবা কার্যক্রম গ্রাম–শহর উভয় অঞ্চলেই বিস্তৃত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখা ১০ হাজার ৫০০–এর কাছাকাছি। নভেম্বর ২০১৯–এর তথ্যমতে, দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬৯টি শাখা গ্রামাঞ্চলে এবং ৫ হাজার ৩৯৮টি শাখা শহরাঞ্চলে অবস্থিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ এখনো গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে; যদিও তাদের আর্থিক সক্ষমতা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। যেমন বিশাল গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখা সংখ্যা এখনো শহরের তুলনায় বেশ কম; নিয়ন্ত্রণমূলক আইন থাকা সত্ত্বেও।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকদের লেনদেন। খাগড়াছড়ি সদর, ৭ এপ্রিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ফাইন্যান্সিয়াল এক্সেস সার্ভে অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা ছিল ৮ দশমিক ৯৬টি। পাকিস্তান ও ভারতে এ সংখ্যা যথাক্রমে ১০ দশমিক ২ ও ১৪ দশমিক ৬। জাপানে এ সংখ্যা ৩৪ দশমিক ১ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ দশমিক ৯। পরিসংখ্যানটির বৈশ্বিক গড় মান ১১ দশমিক ৫।

বিস্তারিত তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ বৈশ্বিক গড় মানের নিচে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও এটা বাংলাদেশের ওপরে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সেবা ও পরিষেবাগুলো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছের পৌঁছাতে যথেষ্ট নয়। যদিও এ দেশে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অতি প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হয়।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংক ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা এবং তার বিস্তৃত সেবাদানের কথা ভাবতে হবে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসার টিকে থাকা ও বিস্তার লাভের জন্য বিশেষায়িত সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হোম লোন মর্টগেজের সহজীকরণ হলে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত সবাইকে আর্থিক অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।

বিশেষায়িত সেভিংস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশের আনাচে–কানাচে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সব সঞ্চয়কারী বিশেষভাবে সঞ্চয়ে উৎসাহিত হবে। সঞ্চয় ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত বিধায় এসব সেভিংস ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি সুদ দিতে পারে। সেই সঙ্গে গ্রামগঞ্জে, শহর, বন্দরে, নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে ঋণ সমবায় গঠনে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। এতে তারা নিজেদের মধ্যে সঞ্চয় গঠন এবং তার সম্যক ব্যবহারে মনোযোগী হবে। অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সুশাসন চর্চা এবং ক্ষমতায়নও সম্ভবপর হবে।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের প্রাথমিক কার্যাবলি তথা আমানত গ্রহণ ও ঋণদানের পাশাপাশি আরও বহুবিধ কাজ ও সেবা প্রদানে জড়িত। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সঠিক সেবা পেতে চাইলে তাদের বিশেষায়িত সেবার দিকেই ঝুঁকতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষায়িত সেবা প্রদানে আগ্রহী হলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা আরও বিকাশ লাভ করবে। অর্থনৈতিক সেবা–পরিষেবায় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে ডিপোজিটরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ভূমিকা পালন করতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি সেভিংস অ্যান্ড লোন অ্যাসোসিয়েশন, সেভিংস ব্যাংক ও ক্রেডিট ইউনিয়নের মতো অন্যান্য ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণে সফল হলে এসব প্রতিষ্ঠানও টিকে থাকবে এবং বিকশিত হবে। সত্যিকার অর্থেই আপামর জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ করতে চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটাতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ আরও সহজতর হবে এবং গতি লাভ করবে।

শহীদুল জাহীদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক