স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কৃষি খাত। গত দুই বছরে করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষি খাতই আমাদের দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছিল। গত দুই বছরে পৃথিবীর মহান পেশায় নিয়োজিত কৃষক ভাইয়েরা করোনাকে অগ্রাহ্য করে আমাদের জন্য খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেছিলেন।
অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্যঘাটতির দেশ। দেশে প্রতিবছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো প্রায় ১৪ থেকে ২২ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্যঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০ থেকে ৩১ লাখ টনে। বর্তমানে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। ফলে, এখন সেই ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৪ শতাংশেরও নিচে।
বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে। কিন্তু বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বোরো মৌসুমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আগাম বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে বিপুল ধান ঘরে তুলতে পারেননি চাষিরা। সম্প্রতি ধানের কিছু জাতে ব্যাপক ছত্রাকজাতীয় রোগ দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এ–জাতীয় রোগ দূরীকরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তাই এ বছর চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কম হতে পারে।
তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আলু উৎপাদনে অষ্টম ও গম উৎপাদনে ষষ্ঠ বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখেরও বেশি। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং তা দিন দিন বাড়ছে। যেখানে কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি, সেখানে দেশের অর্থনীতির এই চরম সংকটকালে কৃষি খাতকে অবশ্যই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, সংকটকালে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র কৃষিকে সমৃদ্ধ করেই আমরা খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারব।
বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার সুফল সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। সমাজের বহু মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। তা ছাড়া সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরম আকার ধারণ করছে। মাথাপিছু আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু সমাজের আয়বৈষম্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আসন্ন বাজেটে আয়বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা, প্রাপ্য মর্যাদা না থাকায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্রামের অনেক মানুষ উৎপাদনবিমুখ হচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে দেশের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ না বাড়িয়ে কাগজি মুদ্রা ছাপালে দেশে মূল্যস্ফীতি হবে। তাই কৃষিকাজে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে উৎসাহিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট হবে দেশের ৫১তম বাজেট। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এতে মোট দেশজ ও উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন বাজেটে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। তাই আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ আসা উচিত।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় জিডিপিতে কৃষি খাতের (শস্য, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাত) অবদানের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। স্বাধীনতার প্রথম দশকে জিডিপির অর্ধেকের বেশি আসত এ খাত থেকে। কারণ, তখন অন্যান্য খাত সেভাবে প্রভাবিত ও প্রসারিত হয়নি। বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। জিডিপিতে কৃষি খাতের সরাসরি অবদান কমে গেলেও কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত। অন্যদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই কৃষি খাতকে শক্তিশালী করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে ১৯৯২ সালের পর কৃষি খাতে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। কারণ, ১৯৯২ সালের পর সরকার থেকে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার ফলে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৫), যা ছিল এখন পর্যন্ত কৃষি খাতের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। এর পর থেকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমতে থাকে এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর থেকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমতে থাকে। এমতাবস্থায়, আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। আসলে বেশ কয়েক অর্থবছর ধরে ৯ হাজার কোটি টাকার আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ। এ খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনার বিশেষ সুবিধাগুলো মূলত কৃষক ও এসব সুবিধার বৃদ্ধি তাঁদের বেশি পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুনঃ
উল্লেখ্য, ২০০০ সালেও কৃষিতে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশ। গত দুই দশকে কৃষিশ্রমিকের পরিমাণ কমতে থাকায় এখন ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ফলে কৃষি মজুরের সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনি মূল্যও অনেক বেড়েছে। দেশের অধিকাংশ কৃষকের পক্ষে বাড়তি শ্রমমূল্যে চাষাবাদ করা অলাভজনক হয়ে পড়েছে। তাই কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। কৃষি চাষাবাদ, কর্তন, প্রসেস করার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে কৃষি ভর্তুকির আওতায় সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কৃষি ঋণের ব্যবস্থাও আসন্ন বাজেটে করা জরুরি। একসময় নতুন কৃষিপ্রযুক্তি প্রসারের একমাত্র বাহন ছিল কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী। এখন তাতে যোগ হয়েছে ই-কৃষি। কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য মুঠোফোন অ্যাপস ব্যবহার করে বাড়ি থেকে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন কৃষকেরা। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ই-কৃষির ধারণা মোটেও রাখেন না, তাই তাঁরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার কারণে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের মাঠে গিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে হবে। অধিদপ্তরে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং তাঁদের দক্ষ করে তুলতে আবশ্যকীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে এবং কৃষি খাতকে ত্বরান্বিত রাখতে আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দকরণ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
রনি সরকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর