দেশের প্রায় ৮ ভাগের ১ ভাগ মানুষ বাস করে রংপুর বিভাগে। দীর্ঘকাল ধরে সরকারি বরাদ্দ কম থাকায় দেশের সবচেয়ে কম উন্নত এলাকা বলে পরিচিতি পেয়েছে এই বিভাগ। দেশে যখন গড় উন্নয়ন লাফ দিয়ে ওপরে ওঠে, তখনো নিচে নামে রংপুরের গড় উন্নয়ন। সরকারি কোনো বরাদ্দ থাকলে স্বাভাবিকভাবে ৮ ভাগের ১ ভাগ পাওয়ার কথা রংপুরের। সেখানে ১০০ ভাগেরও ১ ভাগ পাচ্ছে না রংপুর বিভাগ। বিশেষ সুবিধা দূরে থাকুক, স্বাভাবিক প্রাপ্তিটুকু চলতি অর্থবছরে জোটেনি রংপুর বিভাগে।
চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) সরকার বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা রংপুর বিভাগের জন্য শতকরা হারে বরাদ্দ মাত্র দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ মোট বাজেটকে ১০০ টাকা ধরলে রংপুরের ভাগে পড়বে ১ টাকার কম? এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা অতীতে আরও বহুবার ঘটারই কথা। তা না হলে রংপুর বিভাগ সারা দেশের তুলনায় এত পিছিয়ে পড়ল কীভাবে? বণিক বার্তায় ৬ মে প্রকাশিত একটি খবর সূত্রে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ জানা সম্ভব হয়েছে।
পিছিয়ে পড়া এলাকার জন্য বাড়তি সুবিধার পরিবর্তে বরাদ্দ কম হলেও অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। বরং রংপুর অঞ্চলের মানুষের শীতনিদ্রা শেষ না হওয়া দেখেই অবাক হতে হয়। রংপুরের জনপ্রতিনিধি যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে দু–চারজনকে বাদ দিলে বাকি সবাই ‘দেখব না, বলব না, শুনব না’ ধরনের। গণমানুষের কাছে জনপ্রতিনিধিদের দায় কতখানি, তা–ও বিবেচনাসাপেক্ষ। অতীতে বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে সংসদে একাধিকবার জোড়ালো দাবি উত্থাপন করতে দেখেছি। এই দাবি সংগঠিত হওয়া জরুরি।
বঞ্চনার ইতিহাস
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কোনো সরকার উন্নয়নবৈষম্য দূর করায় সচেষ্ট হয়নি। বরং বৈষম্য জিইয়ে রাখায় সবাই ছিল বদ্ধপরিকর। যারা বিরোধী দলে ছিল, তারাও বৈষম্য বন্ধের দাবি তোলেনি। রংপুরকে পিছিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সব দলের ভূমিকা প্রায় অভিন্ন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। একই তালিকায় সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কুষ্টিয়া জেলার দারিদ্র্যের হার মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই বছর কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তখন সারা দেশে গড় দারিদ্র্য ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। পাঁচ বছর পর গড় দারিদ্র্য কমেছে ৭ শতাংশ। রংপুর বিভাগে ২০১১–এর পরিসংখ্যানে গড় দারিদ্র্য ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ আর ২০১৬ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ। কুড়িগ্রামে বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। বলা যায়, সরকার জ্ঞাতসারেই উন্নয়নবৈষম্য বাড়াচ্ছে। এই নির্মম বৈষম্য থেকে চুল পরিমাণ সরে আসার কোনো চেষ্টা সরকারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তো রংপুরকে বিভাগ হিসেবেই দেখানো হয়নি। সুতরাং, রংপুরের পিছিয়ে থাকা নিয়ে আলোচনাও সদূর পরাহত।
দেশের বিশেষ বিশেষ জেলাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই কি ৩০ লাখ মানুষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল? যে কটি কারণে ৩০ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তার মধ্যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া একটি অন্যতম কারণ।
উৎপাদনের জন্য রংপুর, ভোগের জন্য অন্য বিভাগ?
রংপুর বিভাগে ২ কোটি মানুষের বাস। এখনকার দারিদ্র্যপীড়িত কৃষিসমাজ চার কোটি মানুষের খাদ্যশস্য উৎপাদন করে। তাহলে কি রংপুর বিভাগ উৎপাদনের জন্য আর ভোগের জন্য দেশের অন্যান্য বিভাগ? এটা তো কোনো ন্যায়বিচার হতে পারে না। একটি বিভাগকে দিনের পর দিন পিছিয়ে রাখাটা অসাংবিধানিক।
দলান্ধদের ধারণা
স্থানীয়ভাবে একশ্রেণির দলান্ধ আছেন, যাঁরা পরিসংখ্যান মানেন না, সত্য মানেন না, অন্ধ আনুগত্য আর স্তুতিপাঠেই সময় কাটান। এঁরাই উন্নয়নবৈষম্যকে জিইয়ে রাখার প্রধান শক্তি। দলের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের কাছে মাঠের প্রকৃত খবর তুলে না ধরে অনেকেই রংপুর অঞ্চল উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে, এ কথা জপ করতেও দ্বিধা করেন না। অন্য সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকারের সময় উন্নয়ন বেশি হচ্ছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু অন্য এলাকার সঙ্গে এ এলাকার উন্নয়নে তাই বলে সমতা থাকবে না? দশমিক ৯৮ শতাংশ বরাদ্দ দেখার পরও তাঁরা দাসত্বপূর্ণ অন্য কোনো সহজ ব্যাখ্যা খুঁজবেন?
বৈষম্য দূরীকরণের উপায়
দীর্ঘদিনে জমাটবাঁধা উন্নয়নবৈষম্যের কালিমা দূর করতে হলে সরকারকে সবার আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক–দুই বছরেই সেই কালিমা দূর হবে না। সে জন্য এ অঞ্চলের জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। চরাঞ্চলকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নদীপাড়ের জীবনকে সুরক্ষিত করতে হবে। ঢাকার সঙ্গে রেল-নৌযোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। কৃষিনির্ভর শিল্পকারখানাসহ বাস্তবসম্মত অন্যান্য কারখানা স্থাপন করতে হবে। রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা সহজ করে দিতে হবে। সে জন্য উন্নত সেবাসুবিধা–নির্ভর হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সমতা না ফেরা পর্যন্ত রংপুর বিভাগের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে হবে। ভালো হয়, সরকার যদি বৈষম্য দূরীকরণবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন করে। তাহলে ওই মন্ত্রণালয় সারা দেশের যে সব জেলা উন্নয়নবৈষম্যের শিকার, তার সব কটিরই বৈষম্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। আসন্ন বাজেটেও সরকার বৈষম্য দূরীকরণের প্রকৃত চেষ্টার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
উন্নয়নবৈষম্য দূর করা বৈষম্যবিরোধী মানুষের দাবি হলেও সরকারের জন্য সেটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। বাংলার মাটিতে বঞ্চনা কখনো স্থায়ী হয়নি। তাই ধারাবাহিক বঞ্চনা কালক্ষেপণ না করে বন্ধ করাই বাঞ্ছনীয়। রংপুরের সঙ্গে বৈষম্য প্রায় অর্ধশত বছর ধরে চলছে। আর এক দিনও চলা উচিত নয়। বঞ্চিত জনগণেরও জেগে উঠতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক।
wadudtuhin@gmail.com