আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘ টিকিয়ে রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বাঘ সংরক্ষণে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ে প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়। যেসব দেশের বনাঞ্চলে বাঘ আছে, সেসব দেশে মূলত দিনটি পালিত হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংরক্ষণ সংস্থাও এই দিনে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে। বাংলাদেশও এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করে আসছে। করোনা মহামারির সময়েও বন অধিদপ্তর ও নানা বেসরকারি সংস্থা ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে দিবসটি পালনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘বাঘ বাড়াতে পণ, রক্ষা করি সুন্দরবন’।
একটি প্রাণী রক্ষায় একটি বিশেষ দিন আলাদা করে পালন করার নিশ্চয় যৌক্তিক কারণ রয়েছে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রকৃতিতে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। বর্তমানে এই সংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ বাঘ বনাঞ্চলে বেঁচে আছে। অন্যদিকে, বাঘের পূর্বপুরুষের বসতভিটার ৯৫ শতাংশ এলাকা আজ মানুষের দখলে। একসময় ৩৩টি দেশে বাঘ থাকলেও বর্তমানে ৮টি দেশে বাঘ টিকে আছে। চীন, মিয়ানমার ও লাওসের বনাঞ্চলে দু-একটি বাঘ বেঁচে থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। কম্বোডিয়া ইতিমধ্যে তার সর্বশেষ বাঘটি হারিয়েছে ২০১৬ সালে।
অন্যদিকে, ১৯৯৭ সালের পর ভিয়েতনামের বনে আর কোনো বাঘের দেখা মেলেনি। ফলে কাগজে-কলমে ১৩টি দেশে বাঘ থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে বাঘ আছে মাত্র ৮টি দেশের বনাঞ্চলে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতারা ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে মিলিত হন। ওই সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার করা হয়। বাঘ রক্ষায় গ্রহণ করা হয় নানা কার্যক্রম। সুন্দরবন পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎ বাঘের আবাসের মধ্যে একটি। বাঘ এই বনের প্রাকৃতিক পাহারাদার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঘ সুন্দরবন প্রতিবেশব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী সর্বোচ্চ প্রাণী। ফলে, ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেশব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সুন্দরবনে বাঘের উপস্থিতি অপরিহার্য। সুন্দরবনে বাঘ বেঁচে থাকলে মোটাদাগে আমরা তিন ধরনের প্রতিবেশ সেবা পেতে পারি। প্রথমত, বাঘ থাকলে বনের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে বিধায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব প্রশমনে এই বন অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
দ্বিতীয়ত, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে এই বন প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে কাজ করে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তৃতীয়ত, অফুরান মৎস্য ও বনজ সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সুন্দরবন প্রায় ১০ লাখ মানুষের যে জীবন-জীবিকার সংস্থান করে চলেছে, তা অব্যাহত থাকবে। তাই সুন্দরবনের গুরুত্ব শুধু আম্পান কিংবা বুলবুলের সময় অনুধাবন করলে চলবে না, বছরের বাকি সময়ে এর নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে।
সুন্দরবনে বাঘ কেমন আছে—এটি জানতে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর বাঘের জরিপ করা হয়। অতীতে বেশ কয়েকটি বাঘ জরিপ হলেও ২০১৫ সালে প্রথম সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি জরিপ সম্পন্ন হয়। এতে আমাদের সুন্দরবনের ১০৬টি বাঘ থাকার তথ্য উঠে আসে। ২০০৪ সালে পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে ওই জরিপ ছিল অগ্রহণযোগ্য। ২০১৭ সালে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং পদ্ধতিতে সম্পাদিত এই লেখকের একটি গবেষণায় সুন্দরবনে ১২১টি বাঘ থাকার তথ্য জানা যায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জরিপে ১১৪টি বাঘ গণনা করা হয়। এসব জরিপ থেকে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের অবস্থা স্থিতিশীল আছে বলে ধারণা করা যায়।
বন্য প্রাণীর অবৈধ ব্যবসাসংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ট্রাফিকের ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট মতে, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে চোরা শিকারিরা আমাদের সুন্দরবনে ৩৩টি বাঘ হত্যা করেছে। চলতি বছরে আরও ৩টি বাঘের অপমৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি বাঘ চোরা শিকারিদের ফাঁদে আটকে আহত হয়ে পরে মারা যায় বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে সুন্দরবনে হরিণ শিকার চলছে।
সুন্দরবনে বাঘ তার তিন-চতুর্থাংশ খাদ্য পায় চিত্রাহরিণ শিকারের মাধ্যমে। বাকিটা জোগান দেয় বুনো শুয়োর। পৃথিবীর অধিকাংশ আবাসে ১০ থেকে ১২ প্রজাতির খাদ্যপ্রাণী থাকলেও আমাদের সুন্দরবনে রয়েছে শুধু চিত্রা হরিণ ও বুনো শুয়োর। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ সুন্দরবনের চিত্রাহরিণের নিয়মিত খাদক। স্থানীয় সংঘবদ্ধ শিকারিরা এই চিত্রাহরিণ শিকার করে। করোনাকালেও এই চোরা শিকারিদের তৎপরতা থেমে নেই। সেই সঙ্গে হরিণের জন্য পেতে রাখা ফাঁদে আটকে মারা পড়ছে বাঘও। বিষটোপের মাধ্যমে শিকারিরাও সুন্দরবনের বাঘ শিকার করে থাকে। এসব চোরা শিকার অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে সংগঠিত হওয়ায় এগুলোর খুব কমই আমরা জানতে পারি।
হিমালয়ের দেশ নেপাল চার বছর আগেই বাঘ দ্বিগুণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে। ভারতও দ্বিগুণ করার কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের বন অধিদপ্তর বাঘ রক্ষায় নানা কার্যক্রম গ্রহণ করছে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও বাঘ সংরক্ষণে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। গত ১০ বছরে বাঘ রক্ষায় আমাদেরও কিছু অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাঘের জরিপ করা, রাজস্ব ব্যয়ে স্মার্ট নামে বিশেষ একটি টহল ব্যবস্থা চালু করা এবং বাঘের মোটামুটি একটি স্থিতিশীল অবস্থা ধরে রাখা অন্যতম। এসব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনে চোরা শিকার বন্ধ করতে না পারা আমাদের বড় ব্যর্থতা। বাঘ রক্ষায় নেপাল কিংবা ভারতের পথে হাঁটতে হলে স্মার্ট টহল ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হবে, না হলে এই চোরা শিকার বন্ধ করা যাবে না।
পৃথিবীর আর কোনো ম্যানগ্রোভ বনে বাঘ টিকে নেই। বিরল এই বনে বেঁচে থাকা বাঘের জিনগত ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যও কিছুটা আলাদা। মাত্র দুটি খাদ্যপ্রাণীর ওপর এই বাঘ পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। তাই সুন্দরবনের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বাঘকে টিকিয়ে রাখতে হলে চোরা শিকার বন্ধ করা ছাড়া বাঘ রক্ষা কিংবা সংখ্যা বাড়ানোর অন্য কোনো উপায় নেই।
ড. এম এ আজিজ: বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক।