বাংলা চর্চায় আমাদের অনীহা

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম একদিন আমাকে বললেন: ‘আব্বাসী, প্রতিদিনই লিখি, রাত তিনটায় উঠেও। কেন জানো? এটি না হলে ঘুম আসতে চায় না। রোজ কলম ব্যবহার করবে, না হলে কলম সরবে না।’ ‘সিলভারস্প্রিং’-এ ওনার পাশের ঘরে আমার বেডরুম। রোজ রাতে দেখি তাঁর ঘরে আলো জ্বলছে অর্থাৎ তিনি তাঁর কাজটি করছেন। গত তিন মাসে ‘কলাম’-এ আসিনি, তবে বইমেলায় উপস্থিতি কটি বই নিয়ে। তেমনি আমার ক্ষেত্রে সকালে গলা না সাধলে দিনটি মনে হয় শুরুই হয়নি।
ভাষার মাসে ভাষা ছাড়া কিছু বলা যাবে না, অথচ ভাষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ যে অস্তিত্ব, তা ভুলে যাই। ঘরে কেন আগুন, কেউ জিজ্ঞেস করছে না, কেন মানুষ অমানুষ, জিজ্ঞেস করছি না। বিশ্বাস আমাদের গভীরতর। শুধু ভাষার স্থানই নয়, আছে ডায়ালেক্টেরও। ইংরেজিতে এর নাম: ‘গাটারাল ইন্টোনেশন’। বাংলার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আবহাওয়ায় যে ভাষা বেড়ে ওঠে, তার মতো আর কোনো ভাষাতে বাঙালি খুঁজে পাবে না আমৃত্যু তার অস্তিত্ব।
রেডিও ও টেলিভিশনের চ্যানেল-সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অনুপাতে ভাষাচর্চা যদি হতো দিন-রাত, অবশ্যই আনন্দিত হতাম। সব জীবিত ভাষা গতিশীল, যা ভাষাকে করে সংস্কৃত, আধুনিকতর। ফলে বানান পরিবর্তিত হয়, অব্যবহূত শব্দ বাদ পড়ে। পাহাড়ি নদীর মতোই এর এগিয়ে চলা, ততই স্ফূর্তি, ততই সহজ ও সমতলের পানে ছুটে যাওয়া।
অভিধানচর্চার বালাই নেই, শব্দ নির্বাচনে নেই সাবধানতা, বানান ও উচ্চারণে অনবধানতা। আদর্শ কথ্য বাংলার উচ্চারণ কী হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের নেই মাথাব্যথা। ধরা যাক, পদ্ম শব্দটি। এটি কীভাবে উচ্চারিত হবে, তা ভেবে দেখেন না, না-শিক্ষক, না-গায়ক। এটি উচ্চারিত হবে ‘পদেদা’ নয়, ‘পদেদাঁ’, কারণ পদ্মর গর্ভে ‘ম’ আছে। উচ্চারণের সময় ‘ম’টির কথা ভুলে বসে থাকি। এমন আরও বহু শব্দ, যার মধ্যে ‘ম’-র উচ্চারণ লুক্কায়িত। একটি ছেলে গান গাইছে। গানটি: ‘পদ্মার ঢেউ রে’, সে ভালোই গাইল, গোড়াতেই গলদ। গানের সময়ও পদেদাঁই হবে। কে শেখাবে?
শিক্ষিত লোকদের কাছে অভিধান অর্থ বর্ণানুক্রমিক অর্থসংবলিত বই। আসলে তা নয়। শব্দের প্রাথমিক অর্থকে বলা হতো অভিধান। আর যে গ্রন্থে সেই প্রাথমিক অর্থ ধরা থাকত, তা-ই অভিধান। শব্দের মুখ্যার্থ বর্ণনা করলেই অভিধান সংকলকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আজ আমরা যাকে অভিধান বলছি, তাকে একসময় বলা হতো শব্দার্থ কোষ। ধরে নিয়েছি ‘ডিকশনারি’ অর্থ অভিধান এবং ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’র অর্থ কোষ বা জ্ঞানকোষ। অভিধানের চেয়ে শব্দকোষ নামটি যুক্তিযুক্ত। বাংলা ভাষায় রয়েছে শত শব্দকোষ। প্রয়োজন হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এই শব্দকোষের ব্যবহার।
আমাদের রচিত বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু নতুনদের ক্ষেত্রে তা নয়। আমার নাতি-নাতনিদের কথা বলছি। শব্দ ও ভাষা নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা দূরের কথা, বরং যা কিছু অর্জিত তার প্রতি অনীহা। যেকোনো ভাষাই প্রধানত মুখের ভাষা। লিখিত সাহিত্যের ব্যাপারে তা আলাদা। আমরা সব সময় দৃষ্টি দিই, যাতে তার রূপ থাকে দৃষ্টিনন্দন। সে কারণে উচ্চারণে দিকটি রয়ে যায় উপেক্ষিত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডায়ালেক্ট নিয়ে অনেক কথা উঠেছে, টেলিভিশন ও রেডিওতে যখন শোনা যায় সিলেটি অথবা চট্টগ্রাম অথবা নোয়াখালীর ডায়ালেক্টে সুজন ব্যক্তিরা ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছেন এতটুকু ভ্রুক্ষেপ না করে, বোঝা যায় যে উচ্চারণকোষ আমাদের শিক্ষার আওতা থেকে বাইরে কেন। সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর ১২৪ পৃষ্ঠাব্যাপী বাংলা ভাষা চর্চা বইতে এ নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা শেষে সংবাদপত্রের শিরোনাম নিয়ে অনেক মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের সংবাদপত্রে মোটামুটি সরল শিরোনাম, যাতে সংক্ষেপণ ও বিরাম চিহ্নের ব্যবহার সীমিত। ভাষা যদি এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে সংক্ষেপণ ও বিরাম চিহ্নেরও প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি। পাঠক ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবেন, এটাই কাম্য।
প্রথম আলো ভাষাচর্চার যে উন্নত নীতিমালা প্রতিদিনের কার্যক্রমে প্রকাশ করে চলেছে, তাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। ‘ভাষাযোগ’ তাদের একটি নিয়মিত কার্যক্রম। তমদ্দুন মজলিশ প্রবর্তন করেছে ‘মাতৃভাষা পদক’। অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আমাকে ২০১১ সালে ‘মাতৃভাষা পদক’ দেওয়া হয়। এই পদকে সম্মানিত হওয়ায় আনন্দিত আমি, কারণ তমদ্দুন মজলিশ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ।
কদিন আগে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। দুই বছর ধরে বইটি লেখা হয়েছে, কাজী নজরুল ইসলাম: ম্যান অ্যান্ড পোয়েট। কোথাও খবরটি গুরুত্ব পায়নি। ছেলেমেয়েরা ভাষার শ্রেষ্ঠ আকর রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান আউড়ে গেছে, প্রবেশাধিকার পায়নি ভেতরে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সবই আছে, নেই বাংলা।
প্রধান অতিথি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দুঃখ করে বললেন, ‘বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেলাম, মাতৃভাষার প্রতি আমাদের অনুরাগ বচনসর্বস্ব।
পৃথিবীর কাছে নজরুলকে পৌঁছে দেব ইংরেজিতে, ফরাসিতে, আরবিতে, জাপানিতে—সেটা ঠিক আছে। কিন্তু নজরুল অধ্যয়ন, রবীন্দ্র অধ্যয়ন হবে কোন ভাষায়? তার চর্চা কে করবে?’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net