মুঠোফোনে এসএমএস পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএসসহ সব চাকরির পরীক্ষায় চলছে ডিজিটাল পদ্ধতির নকল।
আমাদের দেশে কয়েক বছর আগেও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-স্নাতক পরীক্ষাগুলোয় অনেক কেন্দ্রে নকলের উৎসব হতো। বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের আন্তরিকতাপূর্ণ প্রচেষ্টায় সেই নকল প্রায় বন্ধই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এবং চাকরির অনেক পরীক্ষাই
হতো লিখিত পদ্ধতিতে। সেখানে অনেক সময় মূল্যায়ন যথাযথ হতো না এবং দুর্নীতি করার সুযোগও ছিল অনেক বেশি।
সেই দুর্নীতি রোধকল্পে বর্তমানে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এমসিকিউ পদ্ধতিতে সব পরীক্ষার্থীর ফল প্রকাশ করা হয়। সে কারণে মেধাক্রম লঙ্ঘন করার কোনো উপায় থাকে না। ফল প্রকাশ করতে সময়ও লাগে অনেক কম। কিন্তু সেই পদ্ধতি এখন হুমকির মুখে। অত্যন্ত সহজে মুঠোফোনে পরীক্ষায় নকল করে সবচেয়ে ভালো ফল করা সম্ভব। অনেক শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিপুল অর্থের বিনিময়ে এ কাজগুলো করছে বলে শোনা যায়। যে পদ্ধতিতে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীরা অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে থাকে, যদি তা বন্ধ করা না হয়, তাহলে পরীক্ষা কেবলই প্রহসন হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় কিংবা চাকরির বাছাই পরীক্ষায় সংশ্লিষ্টজনেরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করাসহ পরীক্ষার যাবতীয় কাজ শেষ করেন। কখনো কখনো প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয় না তা নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে কখনো কখনো পরীক্ষা বাতিল হয়, কখনো হয় না। কিন্তু প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে ফাঁস না হয়েও নকলের কারণে মেধাবীরা বাদ পড়ছে।
ভর্তি পরীক্ষাসহ সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এসএমএস পদ্ধতির নকলের কারণে বর্তমানে অবলম্বন করা সতর্কতা ও গোপনীয়তার মূল্য প্রায় অনেক ক্ষেত্রে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরিদর্শক কিংবা সংশ্লিষ্ট যে কেউ অসৎ অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্নপত্রের মুঠোফোনে ছবি তুলে বাইরের দুর্নীতিবাজ চক্রের কাছে পাঠান। এ কাজটি করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে মাত্র। বাইরের চক্রটি সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের মধ্যে উত্তর প্রস্তুত করে পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠাতে পারে। এ কাজটি এসএমএস কিংবা ফোনালাপে করা সম্ভব। কানের মধ্যে ছোট্ট একটি হেডফোন বসিয়ে রেখে ব্লুটুথের মাধ্যমে শরীরের যে কোথাও লুকিয়ে রাখা মুঠোফোন থেকে শুনে উত্তর লেখা সম্ভব।
যারা এ কাজগুলো করে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলেও তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পরীক্ষাকক্ষে মুঠোফোন নিয়ে আসাকে বই নিয়ে আসার চেয়েও বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এই অন্যায় বন্ধ করতে কয়েকটি পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে। মুঠোফোন পরীক্ষার হলে আনা বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করতে হবে। শুধু মুঠোফোন নয়, সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষাকক্ষে নিষিদ্ধ করতে হবে। ঘড়ি কিংবা ক্যালকুলেটরের
মধ্যেও সিম বসিয়ে সেই সিম সক্রিয় করে সেখানে এসএমএস পড়া সম্ভব। প্রতিটি পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীর সময় দেখার জন্য দেয়ালঘড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাতে করে সব পরীক্ষাকক্ষে একটি করে দেয়ালঘড়ির ব্যবস্থা করা কঠিন
কিছু নয়।
যদি এটা করা সম্ভব না হয়, তবে পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন করে শতভাগ না হলেও অনেকাংশে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সাধারণত পরীক্ষায় তিনটি অথবা চারটি সেট করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে, তারা যে সেট পায়, সেই সেট প্রশ্নপত্রের উত্তর পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠায়। পরীক্ষার্থী যে সেটের প্রশ্নই পেয়ে থাকুক না কেন, সে বাইরের এসএমএস নির্দেশিত সেট কোডটি পূরণ করে। কক্ষ পরিদর্শককে ফাঁকি দেওয়ার জন্য প্রথমে পেনসিল দিয়ে ওই বৃত্তটি ভরাট করে। সে ক্ষেত্রে সেটের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে এবং কক্ষ পরিদর্শক সেটকোডের বৃত্তটি ভরাট করবেন। এভাবে অনেকখানি নকল রোধ করা সম্ভব।
যদি জ্যামার পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, তাতে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া সম্ভব। এ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট এলাকায় মুঠোফোন নেটওয়ার্কে বিঘ্নতা সৃষ্টি করা যায়। যেমন, আমাদের দেশে নিরাপত্তার প্রয়োজনে অনেক সময় মুঠোফোনে জ্যামার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু আছে। দেশের বাইরে অনেক মসজিদে জ্যামার ব্যবহার করা হয়। এতে করে যদি কেউ মুঠোফোন বন্ধ করতেও ভুলে যায়, তবু সেটি নিষ্ক্রিয় থাকবে। পরীক্ষাকেন্দ্রে এটি ব্যবহার করা সহজেই সম্ভব।
তবে বিটিআরসির এ বিষয়ে সতর্কতার প্রয়োজন আছে, যাতে করে যে কেউ মুঠোফোন জ্যামার ব্যবহার করে কোনো অপরাধকর্মে যুক্ত না হয়, সে বিষয়ে সরকারের সচেতন থাকা প্রয়োজন। জনস্বার্থ ছাড়া জ্যামার ব্যবহার করা দণ্ডনীয় বলে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিটিআরসির মাধ্যমে এই সেবা প্রদান করতে পারে। অথবা বিটিআরসির নিবন্ধন নিয়ে যে সময়ে যে স্থানে মুঠোফোন জ্যামার প্রয়োগ করা হবে, তার কারণ উল্লেখপূর্বক সরকারকে অবগত করে ব্যবহার করতে হবে।
পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে যার মুঠোফোন চালু থাকবে, তাকে বহিষ্কার করতে হবে। যে পথেই হোক, মুঠোফোনে নকল বন্ধ করতেই হবে। মুঠোফোন পৃথিবীকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কিন্তু এর অভিশপ্ত দিকটি যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমারা মেধাবীদের জাতি গঠনের কাজে লাগাতে পারব না। যদি পরীক্ষায় নকল বন্ধ করা না যায়, তবে পরীক্ষায় গোপনীয়তা, সতর্কতা—সবকিছুই হয়ে উঠবে বাংলার প্রবাদ ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র মতো। আমরা চাই আঁটুনি শক্ত হোক, গেরোটাও শক্ত হোক।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com