জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের দিকে শুনি, এবারের বইমেলা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মনে মনে স্বস্তি পাই, যাক, এবার তাহলে প্রাণভরে বইমেলা উপভোগ করা যাবে। আমি বইমেলার নিয়মিত একজন অংশগ্রহণকারী। অভ্যাসটা হয়ে গিয়েছিল আশির দশকের শেষ দিক থেকে। মেলা চলাচলে প্রতিদিন বিকেলবেলা এই চত্বরে ঘণ্টা খানেক ঘুরে বেড়াতে আমার ভালো লাগত। নতুন নতুন বই দেখা, কবি-সাহিত্যিকদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো, বই কিনে তাঁদের সই নেওয়া—এসবে পুলক বোধ করতাম।
দিনে দিনে তা কমে আসতে থাকে। জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়তে থাকে লেখক-প্রকাশকের সংখ্যা। দর্শক-ক্রেতায় টইটম্বুর হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ। ঢোকা ও বেরোনোর পথে সৃষ্ট জটলায় ঘটতে থাকে নানা রকমের অপ্রীতিকর ঘটনাও। পুলিশও সেগুলো সামাল দিতে পারে না।
বাংলা একাডেমি এই বইমেলার আয়োজক। তারা এই মেলার পরিসরকে নিয়ে দুই দশক ধরে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার দর্শককুলের গঞ্জনা উপভোগ করে পরের বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। আর ঢাকা এমনই এক দুর্বিষহ শহরে পরিণত হয়েছে, যেখানে হেঁটে একটু বেড়ানোর মতো কোনো জায়গা নেই। সে কারণে উপলক্ষ পেলেই ঢাকার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে শাহবাগমুখী হয়। ওখানে নানা রকমের মানুষ আসে, প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, হাঁটা যায়, ঘুরে বেড়ানো যায়। তার সঙ্গে যদি থাকে বইয়ের অনুষঙ্গ, যেখানে বেশ কিছু লেখকেরও সমাগম হয়, তাহলে নতুন বই দেখা, পছন্দ হলে দু-চারটে কেনা কিংবা প্রিয় কোনো লেখকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া—সে তো বাড়তি পাওনা। সুতরাং এ ধরনের একটি মেলার আয়োজন যারা করবে, তাদের সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দলটির কথা।
এবারের এই একুশের বইমেলাটিতে দুটি প্রধান ত্রুটি ছিল। তার একটি মেলাটিকে দৃশ্যত দুটি পৃথক ভাগে ভাগ করে ফেলা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মেলায় আগত মানুষের সংকুলান না করতে পারা। স্থাপত্যের ছাত্র হিসেবে আমরা শিখেছি যে একটি উদ্দেশ্যে বানানো কোনো আয়োজনকে পাশাপাশি দুটি জায়গায় রাখার জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্বর্তী পরিসর দরকার, যে পরিসর দুটি ভাগের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে, বিভাজন নয়। বাংলা একাডেমি আর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান দুটি ভাগে বিভক্ত। এবারের মেলা ঘুরে দেখা যায় সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গাটিতে বড় আসর। সেখানে সৃজনশীল প্রকাশকদের জন্য স্টল হয়েছে। কিন্তু তার বিন্যাসে শৃঙ্খলা নেই। স্টল নম্বর খুঁজে কাঙ্ক্ষিত প্রকাশনীর স্টল পাওয়া একধরনের বিড়ম্বনা।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা মেলায় আসা লেখককুল আর দর্শক-ক্রেতাদের। পাঁচ ঘণ্টার এই মেলায় ধুলামাখা পথের ওপর দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় থাকে না। অত্যন্ত অবজ্ঞার সঙ্গে একটা ‘লেখক আড্ডা’ নামের পরিসর তৈরি করা হয়েছে মেলার গেটের বাইরে। লেখকেরা কি তাঁদের প্রকাশনীগুলো ছেড়ে গিয়ে বাইরের ওই ছাউনিতে বসে পাঠক সংযোগ করবেন? ফলে ওই চত্বরটিতে প্রায়ই কিছু পরিশ্রান্ত মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের দিয়ে জিরিয়ে নেওয়ার কাজ করছেন। লেখকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টলের সামনে হাঁটাহাঁটি করেই সময় কাটিয়েছেন। কোনো লেখককেই ওই ‘আড্ডা’য় বসতে দেখিনি। বসবেন কেন? পেশা অনুযায়ী মানুষের ব্যবহারিক আচরণকেই প্রাধান্য দিয়ে যে পরিসর তৈরি করতে হয়, সে সম্পর্কে আয়োজকদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
যেকোনো জনসমাগমের জায়গায় চলাচলের পথ নিশ্চিত করার পরই তার অভ্যন্তরের বিন্যাসের কথা ভাবা হয়। সর্বোচ্চ ব্যস্ত সময়ে যে সংখ্যক মানুষের সমাগম হতে পারে, তাদের প্রবেশ ও প্রস্থান পথটি নিশ্চিত হওয়া আবশ্যকীয় একটা বিষয়। এটা তারা অনুমান করতে পারেনি, এটা আমি মানতে নারাজ। বইমেলায় এ বছরের ভিড় আগের বছরের চেয়ে যে একটু বেশিই হবে, সরল পাটিগণিতের ফর্মুলা তা-ই বলে।
শাহবাগ, টিএসসি, সোহ্রাওয়ার্দী ও শহীদ মিনার আমাদের প্রাণের জায়গা। বাঙালির অহংকারের মতো জায়গা। এ জায়গাটির একটি অংশকে স্থায়ীভাবে পায়ে চলা পথ করেও সারা বছরই আমরা নানা আয়োজনে মেতে থাকতে পারি। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশে তো বটেই, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল অনেক দেশেও এমন নাগরিক উদ্যান থাকে। আর সে পরিসরটিকে ব্যবহারকারীর উপযোগী করে তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মহল যেমন স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে একটা স্থায়ী সমাধানের দিকে আসা উচিত। মেলা কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই দেখেছে, অন্তত তিনটি বিকেলে কত হাজার দর্শনার্থী বইমেলায় ঢুকতে গিয়ে কী ভীষণ শারীরিক নাজেহালের শিকার হয়েছেন।
শাকুর মজিদ: স্থপতি ও লেখক।