ফারুকীর 'ডুব': কতখানি অর্জন

এই প্রথম মনে হলো, বাংলা সিনেমা ক্যামেরা দিয়ে গল্প বানাতে শিখে গেছে। সিনেমার ভাষা বোধ হয় এটাকেই বলে।
এই প্রথম মনে হলো, বাংলা সিনেমা ক্যামেরা দিয়ে গল্প বানাতে শিখে গেছে। সিনেমার ভাষা বোধ হয় এটাকেই বলে।

কারও কারও মনে পড়বে, ‘ছুটির ঘণ্টা’ আর ‘মাটির ঘর’ নামে দুটো ছবি ছিল গত শতকের সত্তরের দশকে। এদের আমরা মোটাদাগে ট্র্যাজেডি হিসেবে শনাক্ত করতে পারি। ‘মোটা দাগে’ বললাম এ জন্য যে ট্র্যাজেডি যেমন শুরু থেকেই নিয়তিনির্দিষ্ট পথে এগোয়, ওই ছবি দুটো সেভাবে এগোয়নি। বরং একটা হাসিখুশি সিনেমা মাঝামাঝি কিংবা ক্লাইমেক্সে গিয়ে একটা বিয়োগান্ত পরিণতি নেয়। সেই অর্থে ‘ডুব’ সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম ছবি, যাকে পরিপূর্ণভাবে ট্র্যাজেডির মর্যাদা দেওয়া যায়। শুরু থেকেই যার পরিণতি নিয়তিনির্দিষ্ট। শেষটা আমরা জানি। ট্র্যাজেডি সূত্রেও, হ‌ুমায়ূন সূত্রেও। এমন একটা অনিবার্য ন্যারেটিভকে বয়ান করা সাহসের কাজ। হয় আপনি নিয়তির দাস হবেন, নয় হ‌ুমায়ূনের জীবনীকার হবেন। দুটোই আপনাকে ব্যর্থ করে দেবে। সে রকম একটা পরিস্থিতির ওপর শিল্পী হিসেবে স্বাক্ষর রাখা শিল্পের কঠিনতম চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যেটা তাঁর ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে বহুদূর অবধি পেরেছেন। আমার বিবেচনায় এটি তাঁর সেরা সিনেমা, শত সীমাবদ্ধতা নিয়েও।

কীভাবে ‘ডুব’ সরয়ার ফারুকীর সেরা কাজ হয়ে উঠল? কারণ, এই ছবিটি বাংলা সিনেমায় বেশ কয়েকটি মাইলস্টোন বসিয়ে দিয়েছে এরই মধ্যে। একটির কথা আগেই বললাম। সিনেমার ভাষা নিয়ে আমরা নানান বাৎচিত করি। কী জিনিস সেইটা? বাংলাদেশে পাওয়া যায়? বহুদিন যাবৎ এর উত্তর ছিল, না। চেষ্টাচরিত্র আছে, কিন্তু সেইটা নেহাত অ্যামেচার পর্যায়ের। দৃশ্যময়তা আছে, কিন্তু তা সংলাপের বা বর্ণনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি। দৃশ্যান্তরে ভাঙচুর আছে, কিন্তু সেলাইয়ের দাগ দেখা যায়। এমনকি ফারুকীর বহুলনন্দিত ছবিগুলোতেও। মন্দের ভালো হিসেবে এটাকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ফর্ম হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভিজ্যুয়াল উপন্যাসের চেয়ে বেশি কিছু হচ্ছে না, এই খেদ মনে মনে খুব ছিল।

কিন্তু ‘ডুব’ আমাকে অনেকখানি খেদমুক্ত করে দিল। এই প্রথম মনে হলো, বাংলা সিনেমা ক্যামেরা দিয়ে গল্প বানাতে শিখে গেছে। সিনেমার ভাষা বোধ হয় এটাকেই বলে। প্রমাণ চান, দেখেন তো, আধাআধি পর্যন্ত ‘ডুব’ সিনেমাকে ছাপা হরফে লিখতে পারেন কি না? লিখতে যে পারছেন না বা পারলেও যে ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে, এর কারণ এই না যে ‘ডুব’ নন-লিনিয়ার। নন-লিনিয়ার বা সরলরৈখিক নয়, এমন কাহিনি উপন্যাসে এন্তার আছে। সিনেমায়ও। তাদের লেখা যায়। সেগুলো নিশ্চয়ই ভালো ছবিও হয়। ভালো ছবি তো নানা রকম। কিন্তু সিনেভাষা আছে, অক্ষর নয়, বরং ক্যামেরা কথা বলে, দৃশ্যমানতার নিজস্ব ব্যাকরণ পাওয়া যায়, এ রকম সিনেমা বাংলাদেশে কই? কিছু কিছু চেষ্টা নানান ছবিতে আছে, কিন্তু এর একটি পূর্ণাঙ্গ এবং ম্যাচিউরড মেনিফেস্টো পাওয়া গেল ‘ডুব’ ছবিতে। বাংলাদেশের সিনেমায় এই প্রথম।

তার মানে কি এই যে ‘ডুব’ একটি পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত সিনে-অভিজ্ঞতা? দর্শকের তরফে? সম্ভবত না। এক ‘টেলিভিশন’ ছাড়া ফারুকীর কোনো ছবিই সেটা না। যে কারণে ফারুকীর দর্শক ‘টেলিভিশন’কে খুব উচ্চমূল্য দেন এবং এই একই কারণে ‘টেলিভিশন’ আমার না-পছন্দ। অবিশুদ্ধ, অপূর্ণাঙ্গ শিল্প আমার বিশেষ পছন্দের জিনিস। কারণ, শিল্পী যত বেশি ঝুঁকি নেবেন, শিল্প পারফেকশন থেকে তত বেশি দূরে থাকবে। ‘টেলিভিশন’-এ ফারুকী কোনো ঝুঁকিই নেননি বলা যায়। ‘ব্যাচেলর’ আর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় নিয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশি মনে রাখার মতো করে নিয়েছেন ‘ডুব’-এ। সাফল্য পেয়ে গেলে বেশির ভাগ শিল্পী আর ঝুঁকি নিতে চান না।

কারণ, তত দিনে দর্শকের হৃদয়েও ওই শিল্পীর ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট ছক দাঁড়িয়ে গেছে। তো, সহজের নেশা আরামের পেশা চলুক, নইলে দর্শক যদি চটে যায়! ছকের মায়ায় আটকে পড়া সেই শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্যই জাঁ জেনে একটা ছোট্ট লেখা লিখেছিলেন। লেখাটা ছিল সার্কাসের বাজিকরকে উপলক্ষ করে। জাঁ জেনে তাকে বলছেন, ‘দর্শকের অপরাধ কী, জানো? তুমি যখন তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলাটা দেখাচ্ছ, সে তখন তার চোখ বন্ধ করে ফেলছে!’

‘ডুব’ নিয়ে নানান কথা হচ্ছে এবং হবেও। এর কারণ যেমন ফারুকী, তেমনি হ‌ুমায়ূন আহমেদ। বরং অলক্ষ্যে হ‌ুমায়ূন আহমেদই কথা বলবার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। নানান কারণে হ‌ুমায়ূন-আখ্যান থেকে বিযুক্ত হয়ে এই ছবি দেখা বাংলাদেশের দর্শকের জন্য কঠিন। প্রেক্ষাপটটি ফারুকীই তৈরি করে দিয়েছেন বোধ করি। যে কারণে ‘ডুব’ বিদেশে যতখানি অভিষিক্ত হচ্ছে, বাংলাদেশে ঠিক ততখানি হয়তো হচ্ছে না। হ‌ুমায়ূনের মতো এত শক্তিশালী চরিত্রকে ললাটে রাখলে এটাই বোধ হয় ললাটলিখন! পাহাড়ে যেকোনো ঘরই শিশুদের ঘর হয়ে যায়। ‘ডুব’-এর দর্শকের একটা বিরাট অংশ মূলত হ‌ুমায়য়ূন-পাঠক বা হ‌ুমায়ূন-আগ্রহী। তাই হ‌ুমায়ূনকে এড়িয়ে তাদের পক্ষে একটি অনপেক্ষ ‘ডুব’ দেওয়া সত্যিই কঠিন। এটাই ভবিতব্য ছিল। সেই অর্থে ‘ডুব’ যেমন কাহিনি হিসেবে ট্র্যাজেডি, ‘ডুব’-এর আস্বাদনে হ‌ুমায়ূনের প্রায়-অক্ষয় উপস্থিতিও ফারুকীর জন্য আরেকটা ট্র্যাজেডি। ট্র্যাজেডি দল বেঁধেই আসে।

সমালোচনা কবার মতো নানা বিষয় এ ছবিতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই কাজটা গড়পড়তা সমালোচকের জন্য তোলা থাক। এক মুঠ প্রশংসা আর এক চিমটে নিন্দা মিলিয়ে ক্রিটিসিজম-স্যালাইন! ইরফানের বাংলা কানে লাগে, নীতুর ক্ষেত্রে ফারুকী খুব পুরুষতান্ত্রিক, ছবিটি বড় বেশি সাবেরিকেন্দ্রিক, কলকাতায় প্রিমিয়ার করা ঠিক হয়নি, বান্দরবানে যাওয়াটা কতখানি জরুরি ছিল, ছবিতে জাভেদ হাসান আরেকটু বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফিল্মমেকার হয়ে উঠতে পারতেন, ছবির প্রথম অর্ধেক যেভাবে টানে শেষের অর্ধেক সেভাবে টানে না—এ রকম নানা পর্যবেক্ষণ সামাজিক মাধ্যমে নানান আলোচনায় উঠে এসেছে। এগুলোর কোনোটা সমালোচনার মোড়কে, কোনোটা নিন্দার মোড়কে পরিবেশিত। কিন্তু আদতে এগুলো প্রত্যাশাই। সেগুলোকে নোক্তা আকারে হাজির রাখা হয়তো কারও কারও দরকার। কিন্তু আমি তার প্রয়োজন দেখি না। এই ছবিকে প্রশংসা করা ভীষণ জরুরি। প্রথমত, তার ঈর্ষণীয় সিনেভাষার জন্য; বিশেষত, ছোট ছোট অনেক ড্রামাটিক মোমেন্ট তৈরি করবার মাধ্যমে ছবিকে এগিয়ে নেওয়ার যে রাস্তা ফারুকী দেখালেন, তার জন্য। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সিনেমায় প্রথমবার একটি পূর্ণাঙ্গ ট্র্যাজেডি হাজির করবার জন্য। এবং তৃতীয়ত, যথেষ্ট বর্ণিলভাবে ছবিটির প্রযোজনা, বিশ্বব্যাপী বিপণন ও প্রদর্শনব্যবস্থা সামলানোর জন্য। এই তিন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে ‘ডুব’ পাইওনিয়ার হয়ে থাকল।

আর, যা যা আমরা ফারুকীর কাছ থেকে এই ছবিতে পেলাম না, তা তা নিশ্চয়ই আগামী ছবিতে পাব!

সুমন রহমান: কবি; অধ্যাপক, গণমাধ্যম অধ্যয়ন, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস