দূর প্রবাসে যারা, বাংলাদেশের বৈশাখের দিকে তাকিয়ে, অন্তত ফেসবুকের বাসিন্দা যারা, তাদের চোখে বৈশাখের বার্তা। চৈত্রের নিদাঘ জানান দেয় বৈশাখের আগমন। প্রথম দিনটি এল বলে। আগে থেকেই বাতাসে ঝড় তুলে আগমন শিলাবৃষ্টির, সেই সঙ্গে কালো মেঘের ভ্রুকুটি, যাতে কয়েকটি প্রাণের বজ্রাঘাতে নির্বাপণ। যার গেছে, সে-ই জানে শুধু, অন্যের কাছে নেই এর কোনো মূল্য। বাড়ে ইলিশের দাম, সেই সঙ্গে পুরোনো গানগুলোর বিন্যাস, চলে নানা প্রস্তুতি টিভির পর্দায়, নানা সাজের পয়লা বৈশাখ দ্বারে উপস্থিত।
পয়লা বৈশাখ, কী হবে তা দিয়ে? হাটুরে, মাঠুরে, ঘাটুরেদের জীবনে দিনটি কি বয়ে নিয়ে আসে নতুন কোনো স্বপ্নের অভিসার, নাকি শুধু গান, কবিতা আর স্বপ্নালু চোখে নবীনের উল্লাস? অনেক দিন আর বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়ে ওঠে না। সেখানে যারা গান গায়, গান শোনে, তাদের প্রত্যক্ষ করি টেলিভিশনে। তাদের চোখে স্বপ্ন আছে বৈকি।
জাতির সামনে যে স্বপ্ন, তা ফুরিয়ে যায় বৈশাখী হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বিশ্বে যত জাতি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জাতিসত্তা ছিল বাঙালির। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর কয়েকটি সম্মেলনে যাই, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জাপানে। যেখানেই গিয়েছি শুধু বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে, সেখানে যে সম্মান ও করতালি পেয়েছি, তা এখনো ভুলতে পারি না। অভূতপূর্ব সেই উন্মাদনা। বাংলাদেশের অর্থ সেদিন ছিল স্বাধীনতার উড্ডীয়মান পতাকা, নিষ্পেষিত মানুষের জয়ধ্বনি, শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার সূর্য-পতাকা। সে স্বপ্ন দল মেলার আগেই উধাও। আজ সম্পূর্ণ বিভক্ত এক জাতি চলেছি অনির্দিষ্টের পথে। সম্মুখযাত্রায় নেই কোনো সম্মিলিত আদর্শের ছবি। বিভক্তি সব অর্জনকে সাহায্য করেছে জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে।
যে বাঙালি জীবন আমাদের ইতিহাসে, সাহিত্যে, গল্পে, উপন্যাসে ও কবিতায়, তার উত্তরণ কোথায়? গরিবেরা দিনে দিনে নিষ্পেষিত। দিনমজুর, কৃষিজীবী, নিম্নমধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীরা দেনার আবর্তে। কোটি নবীন আজ দিশেহারা বেকারত্বে। তাদের প্রত্যক্ষ করি প্রতিদিন শহরে, গ্রামে, গঞ্জে, ট্রেনে, বাসে, রিকশায়, ঠেলায়। তারা কী দিয়ে ভাত খায় জানি। তারা কেমন করে বেঁচে আছে জানি। প্রতিদিন শত শত শিক্ষিতজন আমার কাছে ধরনা দেয়, আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কিসের লেখক, আমাদের কথা কোনো দিন লিখতে পারেন না, আপনার কলমের জোর কোথায় নির্বাপিত? দিনে দিনে বাড়ে দেনা, লোক বাড়ে, সেই সঙ্গে দলাদলি, রেষারেষি, ঈর্ষা, কলহ, খুন, রাহাজানি। শুনি দুর্বৃত্তের হলাহল চারদিকে, কেউ কারও শাসন মানে না। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে, পুলিশ রক্ষী। পাশের বাড়িতে খুন দিনদুপুরে, এর রহস্য কোনো দিন উদ্ঘাটিত হবে না। দোরে খিল দিই অনেকগুলো, অথচ গ্রিল কেটেও অনায়াসে খুন করা যাবে আমার মতো নিরীহ লোককে।
সমগ্র দেশ হুজুগে মত্ত। কখনো ক্রিকেট, কখনো ফুটবল, কখনো বা বৈশাখের মেলা। যে খেলা জীবনকে মূল্য দেবে না, সে খেলার কী দাম? আমরা নিমগ্ন আত্মপ্রশংসায়। ‘লা তুজাক্কু আন ফুসাকুম’, আত্মপ্রশংসা কোরো না। অথচ কারও প্রশংসায় অংশগ্রহণ না করে মত্ত শুধু নিজ গুণকীর্তনে। এক শিল্পী আরেক শিল্পীর গান পছন্দ করে না, কে না জানে। এক সাহিত্যিক অন্য সাহিত্যিককে সহ্য করতে পারে না, তা-ও জানি। অন্যের লেখা মানেই ফালতু, পড়ার যোগ্য নয়। এটাই শুনে এসেছি। বর্তমানে সর্বযজ্ঞে এই আত্মপ্রশংসা অসহ্য হয়ে উঠেছে।
জায়গা ছেড়ে দিতে হবে তরুণদের, সর্বত্র। তা না হলে ঘটবে বিপদ। চীন দেশ ঘুরে এসে বক্তব্য দিয়েছি প্রাঞ্জল ভাষায়: অচেনা চীন, চেনা আমেরিকা গ্রন্থে। তরুণদের জন্য প্রয়োজন তরুণ আওয়ামী লীগ, তরুণ বিএনপি, অর্থাৎ সবখানেই এমন তরুণদের স্থান, যারা শ্রেষ্ঠ তরুণ, যারা বৈশাখের প্রতিনিধি। যাদের দেখেই চেনা যাবে যে তারাই আমাদের দেশের নেতৃত্বের প্রধান দাবিদার।
‘নওরোজ’ ইরানি সভ্যতার দুই হাজার বছরের পুরোনো নববর্ষের উৎসব। দিনটি ২১ মার্চ। জোরোয়েস্ত্রো ধর্মের কান ঘেঁষে হাজার বছরের ঐতিহ্যে নেচে উঠেছিল সেদিন আজারবাইজান, কুর্দিস্তান, তুরস্ক, উত্তর ইরাক, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিস্তান, কাজাকিস্তান। এতগুলো দেশ কী অভূতপূর্ব উন্মাদনায় মেতে ওঠে নওরোজে, না দেখলে কল্পনা করা যাবে না। নববর্ষ মিলনের বারতা নিয়ে আসে। ইরানের শাহনামা থেকে নেমে এল সেদিন সম্রাট জমশেদ, আলবিরুনির কিতাবুল তাফহিন লি আউইউল সিনাত উল তানজিম কিতাবে পারস্যের নওরোজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বন্দনা।
পৃথিবীতে প্রধান দুটি বাংলাভাষী অঞ্চল—ভারতের পশ্চিম বাংলা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা, আসামেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালি আছে। অথচ বাংলা নববর্ষ পালিত হয় দুটি আলাদা দিনে। একই দিনে হতে দোষ কী? বিবাদভঞ্জন হবে সহজে, যেদিন এক পক্ষ অপর পক্ষকে মূল্য দেবে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net