মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে অনেকের মত হচ্ছে, পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হয়ে গেছে। আবার অনেকের মতে, রাষ্ট্রপতির কাছে জমা না দেওয়ায় কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী একজন মন্ত্রী শপথ গ্রহণের পরপরই মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এবং মন্ত্রী তাঁর কার্যাবলি পরিচালনা করেন। সেখানে তাঁর যোগদান করার কোনো প্রশ্ন আসে না। সরকারি কর্মচারীদের যোগদানের জন্য পত্র দাখিল করতে হয়, যোগদানপত্র দিতে হয়। কিন্তু মন্ত্রীদের বেলায় তা লাগে না। কেননা, সংবিধানে আছে, শপথ গ্রহণের পরই তাঁরা কার্যভার গ্রহণ করেন।
সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র দেওয়ামাত্রই কার্যকর হয়ে গেছে। এখন আর তাঁদের শপথের কার্যকারিতা নেই। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না-করার বিধান আমাদের সংবিধানে নেই। সাংবিধানিক পদ যে মুহূর্তে পদত্যাগ করছেন, সেই মুহূর্তে তা কার্যকর হবে। এর পরে তিনি যদি কোনো কাজ করেন মন্ত্রী হিসেবে, সেটা সাংবিধানিকভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ হবে।
তিনি যে বেআইনি কাজ করে যাচ্ছেন, সেই বেআইনি কাজের জন্য তাঁর দায়বদ্ধতা থাকবে। আমি মনে করি, যে মুহূর্তে আমাদের সংসদ সদস্যরা তাঁদের পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকে তাঁদের পদ শূন্য হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন, সবাই তাঁকে সালাম করেছেন। এখানে আমাদের আইনমন্ত্রী একটা কথা বলেছেন, এটা সম্মতিপত্র। যদি সম্মতিপত্র হতো, তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু প্রচার হয়েছে পদত্যাগপত্র, সংবিধানের ৫৮(১)ক ধারা অনুযায়ী। আর এটাও ঠিক, সম্মতিপত্র বলতে আমাদের সংবিধানে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি এটাকে নাটক হিসেবে নেন, ভবিষ্যতে আমাদের সংসদ সদস্যরা কীভাবে পদত্যাগ করবেন, যদি মহড়া হিসেবে নেন, তাহলে সেইভাবে বলা উচিত ছিল, যদি পদত্যাগপত্র আহ্বান করেন, সেটা এভাবে পদত্যাগ করবেন।
কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ সাংবিধানিক। এতে যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন, উপমন্ত্রী ছিলেন, তাঁদের মান-মর্যাদার প্রশ্ন, দেশের সংবিধানের প্রশ্ন, আইনি প্রশ্ন এবং দেশবাসীর কাছে তাঁদের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সংবিধানে যে বিধান রয়েছে, সেই পদত্যাগপত্র দাখিল করার পরে মন্ত্রী হিসেবে তাঁদের গাড়িতে ফ্ল্যাগ, এমনকি মন্ত্রীর চেয়ারে বসে কাজ করা সম্পূর্ণ সংবিধানপরিপন্থী।
এখানে দুই ধরনের মন্ত্রী আছেন, যাঁরা সংসদ সদস্য নন, তাঁদের ক্ষেত্রে সম্ভবত এটা প্রযোজ্য হবে না। যাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে মন্ত্রী আছেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রিসভা নেই। কেবল প্রধানমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন। এবং সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেন। তাঁর উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন।
আমাদের সংবিধানে আরেকটি বিধান আছে, সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বহাল থাকবেন। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এ রকম বিধান থাকলেও মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন শূন্য পদগুলোতে অন্যদের নিয়োগ দিতে পারেন। ৫৮(১) অনুচ্ছেদের ক উপদফায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’
লক্ষ রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র প্রদান করার সুযোগ নেই। তাই যে কথা বলা হচ্ছে যে তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেননি, সেই যুক্তি অচল। কারণ, সংবিধানে বলা আছে, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করবেন। এবং তাঁরা দেশবাসীর সামনেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করে সংবিধান-নির্দেশিত শর্ত পূরণ করেছেন। তাই তাঁদের পদ শূন্য হয়ে গেছে। এখন তাঁরা বলতে পারেন, তাঁদের পদত্যাগপত্র তারিখবিহীন। তাহলে কি আরেকটি জালিয়াতি হয়ে গেল না?
প্রধানমন্ত্রী তো এ কথাও বলেননি যে আপনারা পদত্যাগপত্র দেন, সময়মতো আমি এটা ব্যবহার করব। জাতির সামনে তিনি তো এই অঙ্গীকার করেননি। তিনি স্পষ্টভাবে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং অনেকে তাঁকে সালামও করেছেন। এর অর্থ, আমরা বিদায় নিয়ে নিলাম। মন্ত্রীদের গাড়িতে এখন জাতীয় পতাকার ব্যবহার একটি অপব্যবহার। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সেদিকে একটু নজর রাখা উচিত হবে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আদালতে যেতে বলেছেন। আমরা কি সব ইস্যুতেই সুপ্রিম কোর্টে যাব? তাহলে পার্লামেন্ট রাখার দরকার কী? সবকিছু ভেঙে দিয়ে তবে সুপ্রিম কোর্টই রাখা হোক। সুপ্রিম কোর্ট থেকেই সব সমাধান মিলবে। রাষ্ট্রের খরচও কমে যাবে। রাষ্ট্র পরিচালনাও সহজ হয়ে আসবে।
রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যদি সমাধানে আসেন, তাহলে উচ্চ আদালত বিতর্কিত হন। সেটা সমীচীন নয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।