আমরা প্রকৌশলী, গবেষণাও করি। আমাদের গবেষণায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেলিং এবং ডেটা সায়েন্সের ভূমিকা প্রধান। বাংলাদেশে কোভিড–১৯ মহামারি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের একটি গবেষণায় প্রাপ্ত কিছু প্রাথমিক ফলাফল এখানে উপস্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি।
যুক্তরাজ্যের ইউকেএইডের সহায়তায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং লিডস বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধের লক্ষ্যে গত বছর বাংলাদেশে আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের তুলনামূলক পরিসংখ্যানগত (statistical) বিশ্লেষণ। উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চ থেকেই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা পরে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। এ বছরের মার্চে বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব আবার বেড়ে যাওয়ায় আবার নতুন বিধিনিষেধ জারি করা হয়। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য বিধিনিষেধগুলো শিগগিরই শিথিল করার চিন্তা চলছে, কিছু ইতিমধ্যেই শিথিল করা হয়েছে (যেমন দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে)। এ অবস্থায় প্রথম দফার বিধিনিষেধগুলোর এবং সমসাময়িক অন্য ঘটনাগুলোর (যেমন ঈদ) তুলনামূলক প্রভাব জানা থাকলে তা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সময়োপযোগী, যুক্তিসংগত ও প্রমাণভিত্তিক (evidence-based) সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে।
প্রথম দফার কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রায় সব কটিরই কার্যকারিতা ছিল ইতিবাচক। দৈনিক কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অফিস এবং গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত। শুরুতে সব দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনাও কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে। তবে অফিস ও গণপরিবহন বন্ধের কার্যকারিতা ছিল দোকানপাট বন্ধের প্রভাবের দ্বিগুণের বেশি
কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বিধিনিষেধের সরাসরি প্রভাব প্রথমেই দেখা গেছে, আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াত এবং কর্মকাণ্ডে। গুগল কমিউনিটি মোবিলিটি রিপোর্টের ডেটা নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছে যে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ প্রায় সব ধরনের স্থানেই (অফিস-আদালত, রেস্তোরাঁ-দোকানপাট, গণপরিবহনকেন্দ্র প্রভৃতি) জনসমাগম রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একই সময়ে মানুষের বাসায় থাকাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, গণপরিবহনব্যবস্থা ও দোকানপাট বন্ধের সিদ্ধান্তের সুফল লক্ষ করা যায় প্রায় সব ক্ষেত্রে। অপর দিকে পোশাক কারখানা বন্ধ করায় অফিস-ফ্যাক্টরি এবং গণপরিবহনব্যবস্থার ওপর চাপ কমলেও বিনোদনমূলক স্থান এবং দোকানপাটে এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়নি। আবার বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার বিধি আরোপের পর বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম বেশ বেড়ে যায়।
প্রথম দফার কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রায় সব কটিরই কার্যকারিতা ছিল ইতিবাচক। দৈনিক কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অফিস এবং গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত। শুরুতে সব দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনাও কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে। তবে অফিস ও গণপরিবহন বন্ধের কার্যকারিতা ছিল দোকানপাট বন্ধের প্রভাবের দ্বিগুণের বেশি। একইভাবে, সীমিত পরিসরে অফিস বন্ধ রাখায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবে এর প্রভাবও ছিল দোকানপাট বন্ধের কাছাকাছি।
তবে গণপরিবহন-ব্যবস্থায় ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনাটির কোনো পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ (statistically significant) সুফল আমাদের গবেষণায় পাওয়া যায়নি। এর কারণ সম্ভবত নির্দেশনাটির শিথিল প্রয়োগ। কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবে মাস্ক পরার বাধ্যতামূলক বিধিরও কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব দেখা যায়নি সংক্রমণ ডেটায়। ‘মাস্ক কাজ করে না’—এ ধরনের ভুল উপসংহারে আসার আগেই বোঝা প্রয়োজন কেন বাংলাদেশের সংক্রমণ ডেটায় মাস্ক পরার নির্দেশনার কোনো প্রভাব দেখা গেল না। এর প্রথম কারণটি হলো মাস্ক পরায় জনসাধারণের অনীহা, যেটার উদাহরণ আমরা দেখেছি বিভিন্ন মিডিয়ায়। আর দ্বিতীয়টি হলো ‘রিস্ক কমপেনসেশন’ অর্থাৎ মাস্কবিধির কারণে লোকজনের আপাতনিরাপত্তাবোধ এবং আগের জীবনধারায় ফেরত যাওয়া। এটার প্রমাণও আমরা পেয়েছি মাস্ক নির্দেশনার পরপরই; বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম নিশ্চিতভাবেই বেড়ে গিয়েছিল। এ দুটি বিধির আপাতব্যর্থতা দুটো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়—১. যেকোনো ভালো নির্দেশনাও অকার্যকর হয়ে যেতে পারে যদি বিধিটি সঠিকভাবে পালন করা না হয়; ২. যেকোনো অনভিপ্রেত ফল এড়াতে জনসচেতনতা প্রয়োজন; শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না, নির্দেশনাটি কেন দেওয়া হলো, সেই ব্যাখ্যাও মানুষকে জানানো দরকার।
এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক ফল সম্ভবত গত ঈদের অনভিপ্রেত প্রভাব। গত বছরের দুটি ঈদের পরপরই কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে দেখা গিয়েছিল। দিন হিসেবে ঈদের স্থায়িত্ব বিধিনিষেধগুলোর চেয়ে অনেক কম হলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণে ঈদের প্রভাব ছিল সেই তুলনায় বেশি। বহির্বিশ্বেও থ্যাংকস গিভিং, বড়দিন ইত্যাদি উৎসবের পর কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে। তদুপরি ঈদ সামনে রেখে এ বছরও দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের গবেষণা সুস্পষ্টভাবে বলছে যে গত বছর রোজার ঈদের আগে দোকানপাট খুলে দেওয়ার ফলে সংক্রমণ বেড়েছিল। তাই নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে, ঈদ উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করা কতটা সঠিক হবে।
কোভিড সংক্রমণে বিভিন্ন স্থানে জনসমাগমের তারতম্যের সরাসরি প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ধরনের স্থানে (অফিস-আদালত, দোকানপাট, গণপরিবহনকেন্দ্র প্রভৃতি) জনসমাগম বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়ার ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে কোভিডের সংক্রমণও বাড়তে বা কমতে দেখা যায়। অন্যদিকে বাসায় বেশি সময় থাকা সংক্রমণ রোধে ভূমিকা রেখেছে।
পরিশেষে, প্রথম দফার বিধিনিষেধের তুলনামূলক কার্যকারিতা বিবেচনা করে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সে সময়ে কোভিডের সংক্রমণ কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল অফিস ও গণপরিবহন বন্ধের নীতি। যেসব নির্দেশনা সঠিক এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ করা কঠিন ছিল, সেগুলোর উপযোগিতাও ছিল কম, ক্ষেত্রবিশেষে ছিলই না (যেমন সীমিত পর্যায়ে গণপরিবহন চালানো)। এটি স্বাভাবিক যে কঠোর বিধিনিষেধগুলো সীমিত নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বেশি কার্যকর হবে। কিন্তু নীতিনির্ধারণের সময়ে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হলো বিভিন্ন বিধিনিষেধের কার্যকারিতার একটি সুস্পষ্ট, তুলনামূলক চিত্র। এ অবস্থায় আমাদের গবেষণার ফলাফল এবং প্রথম দফার নীতিমালার যথাযথ ডেটাভিত্তিক পর্যালোচনা কোভিডের দ্বিতীয় দফার সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সরকারকে সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করছি।
l ড. জিয়া ওয়াদুদ, ড. অন্বেষা এনাম ও ড. শেখ মোখলেছুর রহমান লিডস বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক