প্রথম আলো নিয়ে অমূলক অভিযোগ

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে আটকে রাখা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রসঙ্গে একটি লেখা লিখেছেন এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু। লেখাটিতে প্রথম আলো প্রসঙ্গে তাঁর কিছু অভিযোগ ও মন্তব্য রয়েছে। সে কারণে লেখাটির সঙ্গে প্রথম আলোর বক্তব্য হিসেবে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ-এর লেখা প্রকাশিত হলো

অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় দায়ের করা মামলায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটকের পর আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১৮ মে ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে

১৭ মে সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের আটক ও মামলার ঘটনাটি সাংবাদিক সমাজকে ক্ষুব্ধ করেছিল। সে ঘটনার প্রতিবাদে একাত্তর টিভিও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ‘রোজিনা নির্যাতন প্রশ্নে নিরাপস সাংবাদিক সমাজ’ শিরোনামের ওপরের নিবন্ধেও মোজাম্মেল বাবু দেখিয়েছেন, এই ঘটনার জেরে দেশে সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্রের চর্চাক্ষেত্র কীভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। এ প্রসঙ্গে একাত্তর টিভি এবং মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গে আমরাও একাত্মতা প্রকাশ করি। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

তবে রোজিনা ইস্যুর পাশাপাশি মোজাম্মেল বাবুর লেখায় প্রথম আলো সম্পর্কে এমন কিছু অভিযোগ এসেছে, যা মোটেই তথ্যনির্ভর নয়। মোজাম্মেল বাবু প্রশ্ন তুলেছেন, সচিবালয়ে রোজিনা আটক হওয়ার পরপর প্রথম আলো কেন ব্রেকিং নিউজ হিসেবে সেটি প্রচার না করে খবরটি চেপে রেখেছিল। তাঁর প্রশ্ন, প্রথম আলো খবরটিকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিয়ে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে চেয়েছে কি না।

প্রথমত, প্রথম আলো একটি গণমাধ্যম। এটি কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয় যে তার রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং সে জন্য কোনো ষড়যন্ত্র করবে। দ্বিতীয়ত, প্রথম আলো কখনোই ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতায় নামেনি। এর সম্পাদকীয় নীতি চটজলদি দ্রুততা নয়, বরং স্বল্পতম সময়ে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন। তৃতীয়ত, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কোনো পর্যায়েই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠান এ ঘটনা সম্পর্কে প্রথম আলোর বক্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করলেই কেবল আমরা কথা বলেছি।

বুঝতে হবে, এই ঘটনায় আমরা কেবলই সংবাদদাতা ছিলাম না, সর্বাগ্রে ছিলাম রোজিনার জন্য উৎকণ্ঠিত সহকর্মী। বাংলাদেশে একজন পেশাজীবী সাংবাদিককে নিয়ে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ যে এত দূর গড়িয়ে যাবে, তা ছিল কল্পনারও অতীত। পরবর্তী সময়ে ঘটনার নানা অংশ নানাভাবে উন্মোচিত হলেও, সে সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে যথাযথ কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই প্রথম আলোর সংবাদকর্মীরা সচিবালয়ে ছুটে যান। রোজিনাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য প্রথম আলোর উচ্চ পর্যায় থেকে তখন চলছিল সংশ্লিষ্ট নানা মহলে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা। ইতিমধ্যে যখন ঘটনাটি নিয়ে কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়, তখন আমরা খবর প্রকাশ করি।

এর পরপর মোজাম্মেল বাবু প্রথম আলো সম্পর্কে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এক এক করে সেসব প্রসঙ্গে আসি।

এক–এগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘মাইনাস টু’ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মোজাম্মেল বাবু প্রথম আলোর যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছেন। সংবাদ প্রচার করা ছাড়া প্রথম আলোর কোনো রাজনৈতিক স্পৃহা কখনোই ছিল না, এখনো নেই। কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাই এর যুক্ত থাকার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে গণতন্ত্র এবং মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার কথা প্রথম আলো বারবার তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে।

অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, প্রথম আলোকেও সে সময়ে অসম্ভব চাপে রাখা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে একটি অংশ প্রথম আলোর প্রকাশনা রুদ্ধ করার জন্য তৎপর ছিল। হিযবুত তাহরীরের মতো সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে পত্রিকা বিতরণে বাধা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম আলোর মাতৃ-প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রয়াত লতিফুর রহমানের নাম তারা দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় প্রকাশ করে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চার সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী সে খবর আমরা প্রথম আলোতে প্রকাশও করেছিলাম। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় পরে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে সময় যে রাজনৈতিক দলটি গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার সঙ্গেও কোনো পর্যায়ে প্রথম আলোর কোনো সম্পর্ক ছিল না। থাকার কারণ ছিল না।

মোজাম্মেল বাবু অভিযোগ করেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের পরদিন প্রথম আলো নাকি প্রথম পাতায় নারী ভোটারদের কপালে সিঁদুর চড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতপূর্ণ খবর ছাপিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এমন কোনো ছবি ছাপা হয়নি। ভোটের সাধারণ চিত্র হিসেবে প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটি ছবিকে কোনো কোনো বিদ্বিষ্ট মহল সে সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ছবিতে কোনো সংযোজন-বিয়োজন করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। প্রকাশিত ছবিতে কোনো উপাদান যুক্ত বা বর্জন করা প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির বিরোধী। প্রকাশিত খবরেরও কোথাও সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতের লেশমাত্র নেই। অসাম্প্রদায়িকতাও আমাদের সম্পাদকীয় নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোজাম্মেল বাবু যেমনটা বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বন্ধ করার ব্যাপারেও প্রথম আলো কোনো অবস্থান নেয়নি।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নারীদের কটূক্তি করে একটি গল্প প্রকাশ করার অভিযোগ এনেছেন মোজাম্মেল বাবু। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে ভুল করে তেমন একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। সে জন্য প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি এমন শোচনীয় ভুলের জন্য ক্রোড়পত্রটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছিল।

রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্কুলছাত্র নাইমুল আবরারের মৃত্যুর ঘটনা প্রথম আলো লুকানোর চেষ্টা করেছে বলে উল্লেখ করেছেন মোজাম্মেল বাবু। প্রথম আলোর সে সময়ের পাতা ওলটালেই তিনি বুঝতে পারবেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়।

মোজাম্মেল বাবু তাঁর লেখায় নানা প্রসঙ্গে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারকে একটি অখণ্ড সত্তা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার দুটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এদের পরিচালনা পর্ষদ আলাদা। সম্পাদকীয় নীতিমালা স্বতন্ত্র। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিষ্ঠান দুটি একে অন্যের ওপর কোনোভাবেই নির্ভরশীল নয়। যার যার সম্পাদকীয় নীতি ও অবস্থানের জন্য তারা আলাদা আলাদাভাবে দায়বদ্ধ। ডেইলি স্টার-এ রোজিনা ইসলামের ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যসংবলিত বিজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম নিজেদের মতো করে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।

মোজাম্মেল বাবু প্রশ্ন তুলেছেন, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক আক্রান্ত হলে প্রথম আলো সেই নির্যাতিত সাংবাদিকের পাশে এসে দাঁড়াত কি না। এর উত্তরও তিনি পুরোনো প্রথম আলোর পাতা উল্টে গেলে পেয়ে যাবেন। বস্তুত মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার নীতিতে বিশ্বাসী বলে সাংবাদিক নির্যাতনের খবর আমরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করি।

একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিই। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন হেফাজতে ইসলামের লাঞ্ছনার শিকার হলে প্রথম আলো শুধু তার খবর ছাপিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ৮ এপ্রিল এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ১০ এপ্রিল ‘অধুনা’ ক্রোড়পত্রে তাঁর ছবিসহ প্রচ্ছদকাহিনি বের হয়। এরপর ১১ এপ্রিল প্রকাশিত হয় ‘কেবল মেয়ে বলেই’ শিরোনামে সাংবাদিকতার প্রবীণ অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খানের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ। ঘটনাচক্রে নাদিয়া শারমিন এখন একাত্তর টিভির একজন সংবাদকর্মী।

প্রতিষ্ঠার পর গত ২২ বছর ধরে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাই ছিল প্রথম আলোর লক্ষ্য। সে কারণেই দেশে এবং দেশের বাইরে লাখ লাখ বাংলাভাষী পাঠক আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। ছাপায়, অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বের নিরিখে সংবাদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠকদের এই আস্থাই আমাদের শীর্ষতম অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রকাশনায়, কিশোর ও বিজ্ঞান মাসিকে, ম্যাগাজিনেও সে আস্থারই প্রকাশ। সাংবাদিকতা এবং গণিত অলিম্পিয়াড-ফিজিকস অলিম্পিয়াডসহ নানা কর্মকাণ্ডে সৃষ্টিশীল তারুণ্যের উদ্বোধন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।

প্রতিটি সংবাদমাধ্যমেরই বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার খবর নিয়ে নিজস্ব সম্পাদকীয় অবস্থান থাকতে পারে। তা সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে এবং আমরা সেসব মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মোজাম্মেল বাবুও তা-ই করেছেন। তাঁর মতের সঙ্গে আমরা দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তাঁর মতপ্রকাশের অধিকারকে আমরা সম্মান করি এবং এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

প্রথম আলো সব সময় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে এসেছে। ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর ধারণা পাঠকের মধ্যে যাতে তৈরি না হয়, সে জন্য সব সময় সঠিক তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশেও আমাদের সংকোচ নেই।

সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক