প্রতিবাদে এখন প্রতিরোধের মেজাজ। সাধারণ ধর্মঘটে স্তব্ধ ভারত। টলে গেছে দেশ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। কচ্ছ থেকে কোহিমা। ৪৮ ঘণ্টা আগেই সীমান্ত ‘সিল’ করে দিয়েছে হরিয়ানা সরকার যাতে দিল্লির পথে বেরিয়ে পড়া কৃষকেরা রাজধানীতে প্রবেশ করতেই না পারেন। মধ্যরাতে চলেছে কৃষকনেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। গ্রেপ্তার ৭০ জনের বেশি কৃষকনেতা। রাজ্যে ১৪৪ ধারা। উত্তর প্রদেশে আগামী ছয় মাসের জন্য জারি করেছে এসমা।
ওডিশা সরকার বিধানসভায় এসমা আইন সংশোধন করে তাতে যুক্ত করেছে জেল-জরিমানা। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি দপ্তরে ১০০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বেতন কাটার বিজ্ঞপ্তি। দিল্লিমুখী কৃষকদের আটকাতে জলকামান। গ্রেপ্তারি, যাবতীয় হুমকি উড়িয়ে তবু এক সর্বাত্মক ধর্মঘট। প্রতিরোধের দিনলিপি।
এক বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। বিজেপি ও তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন বাদে সব কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চের ডাকে। সঙ্গে কৃষক ও খেতমজুরদের প্রায় আড়াই শটি সংগঠনের মিলিত মঞ্চ কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের যৌথ লড়াই। বছরের গোড়ায় জানুয়ারির ৮ তারিখ। মহামারি তখনো জনজীবনে, অর্থনীতিতে থাবা বসায়নি। সফল সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে গ্রাম-ভারতে সর্বাত্মক হরতাল। শামিল হয়েছিলেন ২৫ কোটি মজদুর-কিষান। মহামারি সংকটকে আরও তীব্র করেছে। প্রাথমিক হিসাব বছর শেষের ধর্মঘটে সেই সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে। ছাব্বিশ নভেম্বরে ধর্মঘটের মিছিল করেই সাতাশে নভেম্বর কৃষক, খেতমজুরদের ডাক ‘দিল্লি চলো’। এতে শামিল হবেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল এবং মধ্যপ্রদেশের কৃষকেরা। আর দেশজুড়ে জেলায় জেলায় তাঁদের সংহতিতে হবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ।
এই সংগ্রামের প্রধান দাবি—বাতিল করতে হবে করপোরেট কৃষি আইন, ইলেকট্রিসিটি বিল এবং চারটি শ্রম কোড। দেশের স্বাধীন কৃষির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে মোদি সরকারের কৃষি আইন। এটি নিছক সংস্কার নয়। ভারতের অর্থনীতির বনিয়াদি কাঠামোর একেবারে বিপরীত পথে হাঁটা। তিনটি কৃষি আইনের লক্ষ্য কৃষির করপোরেটকরণ। যার ওপর নির্ভরশীল দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ। দেশের খাদ্যশস্যের বাজারকে বিদেশি বহুজাতিকদের মুনাফার জন্য তুলে দিতে চাইছে সরকার। চাইছে কৃষকের জন্য ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অবসান। সংবিধানে কৃষি রাজ্যের বিষয়।
কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না। এদিকে বাজারে আগুন। মাঝে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন। এই সত্যকে চাপা দিতে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে তথ্য দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
মোদি সরকার যদি এই নীতির জন্য দায়ী হয়, তবে সমান দায়ী পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার। তারা একই নীতি রূপায়ণ করে চলেছে। দিল্লির মতো এ রাজ্যের সরকারও করপোরেটের হাতে কৃষিকে তুলে দিতে এপিএমসি অ্যাক্ট আগেই সংশোধন করেছে। সারা দেশের মতো এখানেও কৃষি থেকে কৃষক উচ্ছেদ হচ্ছেন। রাজ্যে বামফ্রন্টের সময় ভূমি সংস্কারের যাঁরা জমি পেয়েছিলেন, তাঁরা অনেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন। কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না। এদিকে বাজারে আগুন। মাঝে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন। এই সত্যকে চাপা দিতে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে তথ্য দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
অন্যদিকে, চারটি শ্রম কোড মানে শ্রমিকের আট ঘণ্টা কাজের অধিকারকে অস্বীকার। ন্যূনতম মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে অস্বীকার। যৌথ দর–কষাকষি, ধর্মঘটের অধিকারকে অস্বীকার। মালিকের হাতে অবাধ ছাঁটাই, ক্লোজারের একতরফা অধিকার।
কী আশ্চর্য, প্রায় এক শ বছর আগে তোলা দাবি স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও আজও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
১৯২২ সালে হয়েছিল কংগ্রেসের গয়া অধিবেশন। সেদিন কমিউনিস্টরা যে ইশতেহার বিলি করেছিলেন, তাতে ছিল শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি, আট ঘণ্টার কাজের অধিকার, ন্যূনতম মজুরির জন্য লড়াই-আন্দোলনের ডাক। গয়া অধিবেশনের সেই ইশতেহারের কথাই পরে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৪) ব্রিটিশ পুলিশ তথ্য-প্রমাণ হিসেবে পেশ করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে।
মার্চ ১৯৩১। করাচি কংগ্রেস। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা তখনো চলছে। অভিযুক্তরা তখনো নিজেদের বক্তব্য পেশ করেননি। কমিউনিস্ট পার্টি সেদিন করাচি কংগ্রেসে বিলি করে ‘ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন’ নামে প্রাথমিক কর্মসূচিগত দলিল। আর তাতে জমিদারতন্ত্র বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে লেখা হয়, ‘ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকেই জমিদার, শাসক রাজন্যবর্গ, মহাজনি কারবারিদের সমস্ত জমি, তাদের দখলে থাকা সমস্ত অরণ্যভূমি বাজেয়াপ্ত করতে হবে...দাস চুক্তিসমূহ বাতিল করতে হবে, মহাজন ও ব্যাংক থেকে নেওয়া কৃষকদের সমস্ত ঋণ মওকুফ করতে হবে।’
নয়া উদারবাদের জমানায় শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপকতম ঐক্য নির্মাণে ব্রতী কমিউনিস্টরা। এই সময়ে উনিশটি সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট। বৃহস্পতিবার ছিল বিশতম ধর্মঘট। তবে এটা শেষ নয়, শুরু। ‘আরও তীব্র, আরও অনমনীয়, আরও দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য এটি সূচনামাত্র।’ একযোগে জানিয়ে দিয়েছে বিজেপি, তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন বাদে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন।
এ বছর ক্ষোভের আঁচ মিলছিল আগেই। ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর রেললাইনের ওপর টানা বসে ছিলেন পাঞ্জাবের কৃষকেরা। বাতিল ২ হাজার ৩৫২টি প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সঙ্গে আরও ৩ হাজার ৮৫০টি মালগাড়ি। শুধু রেলেরই লোকসান ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। পাঞ্জাবে ব্যবসার ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা। লুধিয়ানার স্থলবন্দর ধান্ধারিতে আটকে ১৩ হাজার ৫০০টি কনটেইনার। বন্ধ ছিল পাঞ্জাবের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লা আসেনি ট্রেনে। কাশ্মীরে, লাদাখে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় রসদ পর্যন্ত ট্রেন না চলায় শেষে করতে হয়েছে ‘এয়ারলিফট’। ২৩ নভেম্বর তাঁরা অবরোধ তুলেছেন একটিই শর্তে, ১৫ দিনের মধ্যে যদি কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা জানানো না হয়, তবে আবার বসে পড়বেন রেললাইনে। সঙ্গে ছিল হুঁশিয়ারি, ২৬-২৭ নভেম্বর দিল্লি হবে ‘আন্ডার সিজ’।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ আইন পাস করতে পারে। তবে রাস্তায় খেতে-খামারে-কারখানায় সেই আইন মানছেন না কৃষকেরা, শ্রমিকেরা।
সরকার আইন বানাতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ আইন পাস করতে পারে। তবে রাস্তায় খেতে-খামারে-কারখানায় সেই আইন মানছেন না কৃষকেরা, শ্রমিকেরা। সংসদে পাস হয়ে গেছে লেবার কোড। ধর্মঘট ডাকা মোটেই সহজ ছিল না। মোদি সরকারের লেবার কোডকে প্রথম জবাব দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের বিদ্যুৎকর্মীরা। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে টানা ধর্মঘটে ছিলেন বিদ্যুৎকর্মীরা, বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে। শেষে যোগীকে পিছু হটতে হয়েছে, কথা দিয়েছেন লিখিত, হবে না বেসরকারীকরণ। লেবার কোড অর্ডিন্যান্স পাস হয়ে যাওয়ার পরে ধর্মঘট ডেকেছিলেন প্রতিরক্ষাকর্মীরা। কিছুতেই করপোরেটকরণের নামে বেসরকারি করা যাবে না। টানা ১২ ঘণ্টা দিল্লিতে ধর্মঘটি ইউনিয়নের সঙ্গে মিটিংয়ে বসে কেন্দ্রীয় লেবার কমিশনার, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর যুগ্ম সচিব। শেষে সরকারকে লিখিতভাবে জানাতে হয়েছে, এখনই করপোরেটকরণের পথে হাঁটবে না। এই কদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের ইছাপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে এসেছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বড় কর্তাসহ ভ্যালুয়াররা। কারখানা ঘিরে রেখেছিলেন শ্রমিকেরা, কর্মচারীরা।
গান ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকতে পারেনি কেউ, ফিরে যেতে হয়েছে ভ্যালুয়ার টিমকে। সঙ্গে হুঁশিয়ারি, পরেরবার কারখানার দিকে এলে বিটি রোড ধরে নিশ্চিন্তে ফিরেও যেতে পারবেন না। কোল ব্লক নিলামের বিরুদ্ধে তির–ধনুক নিয়ে, গাঁইতি–শাবল নিয়ে মজদুরেরা। তিন দিনের ধর্মঘটের পর আবার এক দিনের ধর্মঘট। এখন পর্যন্ত নিলাম করে কোল ব্লক বিক্রি করতে পারেনি মোদি সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপির বিরুদ্ধে ডাকা এই বন্ধ্ ব্যর্থ করতে নামে তৃণমূল। সঙ্গে পুরো শক্তি নিয়ে রাজ্য সরকার। ধর্মঘট ভাঙতে সরকারি দপ্তরে ১০০ শতাংশ উপস্থিত নিশ্চিত করতে বেতন কাটার বিজ্ঞপ্তি জারি। শাস্তির নির্দেশিকা। কার বিরুদ্ধে ধর্মঘট, বোঝা দায়। যদিও পারেনি। ধর্মঘটিরা ছিলেন অকুতোভয়। একরোখা। ফতোয়া উড়িয়ে অচল মেহনতির বাংলা। অভূতপূর্ব। বাস, ট্যাক্সি উধাও। এমনকি ওলা, উবার পর্যন্ত। অ্যাপের আঙিনায় গলির দোকান সুইগি, জোম্যাটো পর্যন্ত বেপাত্তা। বন্ধ ব্যাংক। বন্ধ বিমা, সরকারি দপ্তর। বন্ধ এটিএমের ঝাঁপ। বন্ধ শিল্পাঞ্চল। স্কুল-কলেজ। নবান্নের চৌদ্দতলা থেকে মুখ্যমন্ত্রী দেখেছেন স্তব্ধ জনজীবন, রাজ্যবাসীর হিম্মত।
এ লড়াই নীতিবদলের লড়াই। এ লড়াই বিকল্প নির্মাণের লড়াই। এ লড়াইয়ে নৌ-বিদ্রোহের সেই গান:
‘মন্দির মসজিদ গুরদ্বারোঁ নে বাঁট দিয়া ভগওয়ান কো
ধরতী বাঁটি, সাগর বাঁটা, মাত বাঁটো ইনসান কো।’
এ লড়াই আপসহীন শ্রেণি–সংগ্রামে অবিচল থাকার প্রত্যয়। এ লড়াই মজদুর-কৃষাণের ঐক্য। শ্রেণিযুদ্ধ। এ লড়াইয়ের শরীরী ভাষা, ‘হম ভুখসে মরনে ওয়ালে/ কেয়া মত সে ডরনে ওয়ালে...’
শান্তনু দে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক