করোনা মহামারিই আবার বিশ্বকে মানবতার রূপ নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে সহায়তা করছে! দেশে দেশে করোনা সংক্রমণ যত বাড়ছে ততই মানুষের আসল রূপ উন্মোচিত হচ্ছে। মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেখছি, জানছি মানুষ কীভাবে করোনা আক্রান্তদের সহায়তা করছে। অন্যদিকে কিছু মানুষ কারোনার ভয়ে হোক বা মানবিক শিক্ষার অভাবে হোক কীভাবে অমানুষে পরিণত হচ্ছে, সে চিত্রও আমরা দেখতে পাচ্ছি!
হ্যাঁ, এ করোনাকালেই পাহাড়ের আরেক মানবিক চিত্র আমরা দেখতে পেলাম! আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত, খেটে খাওয়া পাহাড়ি মানুষগুলোই এমন দুর্যোগময় সময়ে মানবতার এক অনন্য নজির তৈরি করেছেন। তাঁরা নিজ উদ্যোগে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ফসল মাঠ থেকে ঘরে তুলে দিয়েছেন, শহর থেকে গ্রামে ফেরা কর্মজীবী মানুষের জন্য কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে পাহাড়ের ঢালে ঢালে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে দিয়েছেন, কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষের খাবারের জোগানও গ্রামবাসী করেছেন। ঘরে ফেরা মানুষেরা যখন গণপরিবহনের অভাবে পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছিলেন, তখন পথে পথে তাঁদের জন্য খাবার, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যুবসমাজের প্রতিনিধিরা। ক্লান্ত পথিকের মনে সাহস ও মনোবল বাড়িয়ে তোলার জন্য তাঁরাও পথে পথে শামিল হয়েছিলেন পথিকদের সঙ্গে। হিংসা, হানাহানি, ঘৃণা-বিদ্বেষের মাঝেও এ মানবিকতার দৃশ্য যেন আবার নতুন দিনের আশা জাগিয়ে তোলে!
সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার ফলে সারা দেশ একপ্রকার অঘোষিত লকডাউনে চলে যায়। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকা-চট্টগ্রামে কর্মরত অন্যান্য শ্রমজীবীদের মতো পাহাড়ি শ্রমজীবী মানুষেরাও চরম সংকটে পড়ে যান। ফুরিয়ে আসা টাকাপয়সা নিয়ে শহরে অবস্থান করা তাঁদের জন্য ক্রমে কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলা প্রশাসন নিজ নিজ জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করে। এতে গ্রামে ফিরে যাওয়া শত শত শ্রমিকেরা দিনভর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কোলের বাচ্চা আঁকড়ে রেখে মাঝরাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। তার মধ্যে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের দফায় দফায় বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে সংঘর্ষ ঘটলে কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। যদিও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহায়তায় তাঁরা যাঁর যাঁর গ্রামে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই করোনাকালে পাহাড়ের মানুষের মানবিকতার আরেকটি দিক এখানে তুলে না ধরলে আজকের লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সারা দেশে করোনা আক্রান্তদের সঙ্গে কোথাও কোথাও যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, তার ঠিক বিপরীত চিত্র আমরা পাহাড়ি এলাকায় দেখতে পাই। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে রোগী ও তাঁর পরিবারকে একঘরে করে না রেখে, যতটুকু সম্ভব নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন পাড়া–প্রতিবেশীরা। আক্রান্ত পরিবারের যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাবার প্রতিবেশীরা নিজ দায়িত্বে সরবরাহ করে যাচ্ছেন। শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়, সামাজিকভাবে এমনকি স্থানীয় বাজার কমিটিও নিঃস্বার্থভাবে এই মহৎ ও মানবিক কাজগুলো করে যাচ্ছে। 'মানুষ মানুষের জন্য' মানবতার এ বাণী যে এখনো মরে যায়নি, করোনাকালে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।
পাহাড়িদের সামাজিক এ বৈশিষ্ট্যগুলো কিন্তু অনেক পুরোনোকাল থেকে চর্চিত হয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকে আমরা যা দেখে বড় হয়েছি। বোরো বা আমন চাষের সময় গ্রামের কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারণে জমিতে চারা রোপণ করতে না পারেন বা অনাবৃষ্টির কারণে হালচাষ দেওয়া জমির মাটি শুকিয়ে যায়, তখন গ্রামের সবাই মিলে এক দিন ওই ব্যক্তির জমিতে নেমে চারা রোপণ করে দিয়ে আসতেন। আর তাঁরা যে এটি মহা উৎসাহের সঙ্গে করতেন, তা প্রকাশ পেত যখন তাঁরা সমস্বরে 'রেঙ' (আনন্দ প্রকাশের চিৎকার) দিতেন! এ ছাড়া পাড়ার স্কুল মেরামত কিংবা হাঁটাচলার রাস্তা মেরামতের প্রয়োজন হলে সরকারি অনুদান বা সেবার আশায় বসে না থেকে নিজেরাই মেরামতে বসে যেতেন! অন্যদিকে বান্দরবানের ম্রো পাড়ার লোকেরা করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকেই বাঁশ দিয়ে তাঁদের এলাকা লকডাউন করে রেখেছিলেন। অতীতে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা নিজ নিজ এলাকায় মহামারি প্রতিরোধে এ নিয়ম অনুসরণ করতেন। আর বর্তমান প্রজন্মও সে নিয়ম অনুসরণ করে ভয়াবহ করোনা থেকে মুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আদিকাল থেকে প্রচলিত পাহাড়ি মানুষগুলোর এ মূল্যবোধ থেকে তথাকথিত আধুনিক সমাজেরও অনেক কিছু শেখার আছে।
পরিশেষে যে দাবি নিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই তা হলো, তিন পার্বত্য জেলার মানুষের করোনা পরীক্ষার জন্য অচিরেই যেন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে একটি পিসিআর স্থাপন করা হয়। কেননা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহের পর রিপোর্ট পেতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ওই ব্যক্তি বিভিন্নজনের সংস্পর্শে এসে সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই সরকার ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ বিষয়টি যেন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক