মতামত

পরিবেশকে উপেক্ষা করে উন্নত দেশ হওয়া যাবে না

আম্পান ও ইয়াস থেকে প্রমাণ হয়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
আম্পান ও ইয়াস থেকে প্রমাণ হয়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

আমাদের জীবনধারণ ও সাজানোর প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর বেশির ভাগের দাতাই প্রকৃতি বা বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম)। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দুই ধরনের সুবিধাদি আমাদের সরবরাহ করে বাস্তুসংস্থান (ইকোলজি)। তার মধ্যে জীবনধারণের পানি, খাবার, মসলা, কাপড়ের উপকরণ, আশ্রয়স্থল, ওষুধ ইত্যাদি দৃশ্যমানের অন্তর্ভুক্ত। আর অদৃশ্য সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবনদায়ী অক্সিজেন, কোটি কোটি মানুষের জীবিকার অবলম্বন, নবায়নযোগ্য শক্তি (সৌরশক্তি ও জলবিদ্যুৎ) উৎপাদন ইত্যাদি।

তা ছাড়া বাস্তুসংস্থান জলবায়ু ও রোগ নিয়ন্ত্রণ করে, পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে (যেমন পানি ও অক্সিজেন) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তুসংস্থান আমাদের চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় এবং ঝোড়ো বাতাসের তীব্রতা থেকে বাঁচায়। আম্পান ও ইয়াস থেকে খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে সুন্দরবন এবং অন্যান্য উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন উপকূলীয় অঞ্চলে বাসরত লাখ লাখ জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্বন মজুতের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করে বন বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন বনে সংরক্ষণ করা হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে, জাতীয় পর্যায়ে বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকে আমরা কম গুরুত্ব দিই। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি হেক্টর বন হারিয়ে যায়, আয়তনে যা কোরিয়ার সমান বা কোস্টারিকার দ্বিগুণ (এফএও ও ইউএনইপি, ২০২০)। বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে বন উজাড়ের হার প্রায় দ্বিগুণ। এ দেশে ১৯৯০-২০১৫ সালে বার্ষিক বন উজাড়ের হার ছিল দশমিক ২ শতাংশ (এফএও, ২০১৫)। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২ দশমিক ২২ মিলিয়ন হেক্টর গাছের আচ্ছাদন ছিল, যা মোট ভূমির প্রায় ১৬ শতাংশ। ২০২০ সালে আমাদের প্রায় ২১ দশমিক ৫ হাজার হেক্টর গাছের আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে, যা ১১ দশমিক ৬ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণের সমতুল্য। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আমাদের বন, প্রবাল দ্বীপ, জলাভূমি ইত্যাদি ক্রমে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নদী ও সমুদ্র দূষিত হয়ে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক বন এবং জলাভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন শিল্প স্থাপন ও নগরকে প্রসারিত করতে ক্রমাগত আমরা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে রূপান্তরিত করে চলেছি। প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক আহরণ, ভোগবাদী আচরণ, অত্যধিক লোভ এবং বিদ্যমান রৈখিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল আমাদের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে।

এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার’। বাংলাদেশের জন্য প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত উপযুক্ত, কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে আমাদের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগুলো দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ একটি প্রাকৃতিক বনকে কীভাবে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ শালবনের ক্রম সংকোচন। জাতিসংঘ ২০২১-২০১০ দশককে ‘বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারের দশক’ ঘোষণা করেছে। মূল্যবান ও অতি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক মূলধন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই দশকে তারা একটি মিশন পরিচালনা করছে। উদ্দেশ্য কোটি কোটি হেক্টর বন ও সাগর সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার।

করোনা মহামারিও ইঙ্গিত করে মানব স্বাস্থ্য বাস্তুসংস্থান স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ১৯৮০ সাল থেকে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব তিন গুণের বেশি বেড়েছে। রোগগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জুনোটিক অর্থাৎ প্রাণীবাহিত। আরও জানা যায় যে মানুষের সব সংক্রামক রোগের ৬০ শতাংশই জুনোটিক। প্রাকৃতিক বাসস্থানের ধ্বংস ও ক্ষতিসাধন, জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা হ্রাস, অবৈধ বন্য প্রাণী শিকারসহ বিভিন্ন কারণে কোভিড ১৯, ইবোলা, সার্স, সোয়াইন ও অ্যাভিয়ান ফ্লুসহ জুনোটিক রোগের নাটকীয় বৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো উদীয়মান একটি অর্থনীতি, প্রতিনিয়ত যেখানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কর্মযজ্ঞ চলছে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, সেখানে বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ একটি দুরূহ কাজ। তবু নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সৃজনে বাংলাদেশ বিশ্বে অদ্বিতীয়। বন অধিদপ্তর ১৯৬৫ সাল থেকে ২ লাখ হেক্টরের অধিক উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করেছে। ক্ষয়প্রাপ্ত বাস্তুতন্ত্রকে নিয়মিত পরিচালনা ও পুনরুদ্ধারে সরকার ৫২টি সুরক্ষিত অঞ্চল এবং ১৩টি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা মনোনীত করেছে। এসব অঞ্চল ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য বন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর ইতিমধ্যে অনেকগুলো গ্রাম সংরক্ষণ দল গঠন করেছে। ছয়টি অভয়ারণ্য ঘোষণা এবং প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করায় সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন এবং বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন’। ২০১৬ সালে সংশোধিত জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা তৈরির পর থেকে বেশ কয়েকটি আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে, যার মধ্যে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা পরিচালনা বিধিমালা (২০১৬), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন (২০১৭), সুরক্ষিত অঞ্চল পরিচালনা বিধিমালা (২০১৭), জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৮), বন নীতি (খসড়া ২০১৮), ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমরা আশা করি এই সব নীতি এবং বিধিগুলো টেকসই ভিত্তিতে বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।

জাতীয় সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ে আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই ২০২১ সালের মধ্যেই অবনমিত বাস্তুসংস্থান, বিশেষত বন ও জলাভূমির পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার। বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছে, তাতে যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নেওয়ার সময় পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মধ্যে একটি ভারসাম্য নিশ্চিত করা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, বনবনানি ধ্বংস হয়ে গেছে, পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে, পানি ও বাতাস দূষিত হয়ে গেছে, এমন কোনো দেশকে কেউ উন্নত বলবে না। এতৎসংক্রান্ত নীতিমালা, বিধিমালা এবং সেক্টরোরাল কর্মপরিকল্পনাগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূলধারায় সন্নিবেশিত করতে হবে।

অষ্টম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারের দশক’ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্‌যাপনের এই গতি বজায় রাখতে আমরা বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করতে পারি:

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ সব উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রোগ্রামিং, রাজস্ব সংস্কার, সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং বাজেট প্রক্রিয়াতে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি সন্নিবেশিত করে সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। ২০৪০ বা ২০৫০ সালের মধ্যে বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য অবক্ষয়ের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার একটি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুসারে প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের জন্য ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। তার মধ্যে তহবিল ঘাটতিই রয়েছে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থার ব্যবধান হ্রাসের পাশাপাশি এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নের সমন্বয় ভূমিকা রাখতে পারে।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে প্রচলিত আদেশ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আইনকানুন দিয়ে বাংলাদেশে প্রকৃতি সংরক্ষণে খুব কম সাফল্য এসেছে। তাই উন্নত দেশের মতো প্রকৃতি সংরক্ষণে বাজারভিত্তিক পদ্ধতি যেমন দূষণকারীর ওপর কর বা সবুজ করের প্রচলন করা যেতে পারে। তা ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়, বনভূমি এবং জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় রোধ করার জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনা বা পুনরুদ্ধারে বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্টতা এখনো শিশু পর্যায়ে রয়েছে। মূল কারণ সচেতনতার অভাব এবং বেসরকারি খাতের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা, অপর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা। ওপরে আলোচিত ‘বাজারভিত্তিক পদ্ধতি’ অবলম্বন করে সরকার বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য তহবিল তৈরি করতে পারে। ইকো ট্যুরিজম থেকে উপার্জিত রাজস্ব প্রকৃতি সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতে পারে। করপোরেট সেক্টরগুলো প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব এবং পরিবেশগতভাবে দায়বদ্ধ ব্যবসার সঙ্গেও এগিয়ে আসতে পারে। প্রকৃতি সংরক্ষণে ও বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মডেলটিও অনুসন্ধান করা যেতে পারে। দেশটি মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদান সহায়তা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রকৃতি সংরক্ষণের ভালো উৎস হতে পারে বেসরকারি খাত। আমাদের যুবসমাজ মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রকৃতি সংরক্ষণে যুবসমাজকে নানাভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।

অবশেষে, একযোগে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বৈশ্বিক তহবিল গঠনের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় একটি শক্ত অংশীদারত্ব তৈরি করতে পারে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের এমন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার, যাতে প্রকৃতিবান্ধব সমাধানের লক্ষ্য নীতিনির্ধারকেরা কৌশলগত পরিবর্তন আনতে পারেন। একই সঙ্গে জনসাধারণ নিজেদের প্রাণপ্রকৃতিকে বিনষ্ট না করে সবুজ ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে পারে।

আরিফ মো. ফয়সল জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত
এটা লেখকের নিজস্ব মতামত, কর্মরত সংস্থার মতামত এখানে প্রতিফলিত হয়নি