২০ বছরের যুদ্ধ শেষে ন্যাটো সেনারা ফিরে যাওয়ার ঘোষণামাত্র আফগানিস্তানে সহিংসতার ভূকম্পন শুরু হলো। প্রতি প্রদেশে বাড়তি মাত্রায় নির্মমতা চলছে। মে মাসে খুন-জখম এপ্রিলের চেয়ে তিন গুণ বেশি। স্কুল ও মসজিদের পাশাপাশি হামলার নতুন লক্ষ্যস্থল করা হয়েছে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। রাজনৈতিক দর-কষাকষিতে শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে স্থানীয় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এসব ঘটাচ্ছে, যা দীর্ঘায়িত হতে পারে। দেশটির প্রতিবেশীরাও তাই সম্ভাব্য নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলায় সক্রিয়তা বাড়িয়েছে।
আফগানিস্তান বাংলাদেশের নিকটবর্তী না হলেও সার্কের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশটি বাংলাভাষীদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশটির পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তাকে নানাভাবে চাপে ফেলে। গৃহযুদ্ধের কারণে আফগানদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কিন্তু দেশটির আসন্ন আগামী নিশ্চিতভাবে আবারও কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে স্পর্শ করবে।
ন্যাটো যাচ্ছে; তালেবানদের পরিসর বাড়ছে
আফগানিস্তানে ন্যাটোর শিবিরগুলোতে এখন বাড়ি ফেরার আবহাওয়া। আর কয়েক সপ্তাহ আছে তারা সেখানে। যদিও অনিশ্চয়তা আছে, আদৌ তারা দেশটি ছাড়তে পারবে কি না। তারা চলে গেলে অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেই উদ্বেগে উত্তাল এখন আফগানিস্তান। ন্যাটোহীন অবস্থায় রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের স্পষ্ট কোনো ছবি নেই জনগণের সামনে। এই সুযোগে তালেবানদের প্রতিশোধ হামলার শঙ্কায় অনেকে দেশ ছাড়ছে। সরকার অনেক এলাকা থেকে গুটিয়ে আসছে। ফলে বেসরকারি প্রশাসনও পালাচ্ছে সেখানকার। তাতে তালেবান প্রভাবিত এলাকার আয়তন বাড়ছে।
২০০১-এ ন্যাটোর হামলায় তালেবান বাহিনী কাবুল ছাড়তে বাধ্য হলেও ধীরে ধীরে পাকিস্তানের পরোক্ষ আশ্রয় পেয়ে তারা আবার পুনর্গঠিত হতে পেরেছিল। এ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেই ন্যাটো বিদায় নিচ্ছে। তবে ন্যাটো তালেবানদের এককভাবে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না। তালেবানদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব মানতে প্রস্তুত নেই দেশটির ভেতর-বাইরের অনেক শক্তি। কিন্তু তালেবানদের চাওয়া একক নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কোনো জোট সরকার গড়তে তাদের আগ্রহ কিংবা চেষ্টা নেই। ফলে ন্যাটোর অনুপস্থিতি মানেই দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ বহুপক্ষীয় রূপ নেওয়া। এ রকম ঘোলাটে অবস্থাতেই নাটকীয় নানা ঘটনা ঘটছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কূটনীতিক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে ভারত।
পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের ঘনিষ্ঠতা এবং ন্যাটো-পরবর্তী আফগানিস্তানে নিজস্ব ভূকৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে নয়াদিল্লির আফগান নীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। ইতিমধ্যে মোল্লা বারাদারের সঙ্গেও মতামত আদান-প্রদান হয়েছে তাদের। তাঁর নেতৃত্বেই তালেবানরা গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি করেছিল।
তালেবানদের কাছে টানছে নয়াদিল্লি
হিন্দুস্তান টাইমস-এর ৯ জুনের খবর অনুযায়ী ভারত তালেবানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় নেমেছে। ভারতের বিদেশনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এটা। তালেবানবিরোধী বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে মিলে ভারত গত কয়েক বছর দেশটিতে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এখন তারা এই নতুন অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে মূলত আফগানিস্তানের পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতির কারণে।
অতীতে তালেবানবিরোধী উত্তরের জোটকে কৌশলগত মিত্র মনে করেছে ভারত। যে জোটের নেতৃত্বে ছিল তাজিক ও উজবেকরা। ন্যাটোর মদদপুষ্ট আফগান সরকারের সঙ্গেও উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে তারা পুরোদমে। কিন্তু এখন পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের ঘনিষ্ঠতা এবং ন্যাটো-পরবর্তী আফগানিস্তানে নিজস্ব ভূকৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে নয়াদিল্লির আফগান নীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। ইতিমধ্যে মোল্লা বারাদারের সঙ্গেও মতামত আদান-প্রদান হয়েছে তাদের। তাঁর নেতৃত্বেই তালেবানরা গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি করেছিল। নয়াদিল্লি তালেবান শিবিরের এমন সংগঠকদেরও খুঁজছে, যারা ভারত প্রশ্নে নমনীয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভুক্ত কিছু দেশও চাইছে ভারত আফগানিস্তানের নতুন পরিস্থিতিতে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করুক। পাকিস্তান, চীন ও ইরানের ভূমিকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারতকে বিশেষ প্রয়োজন ন্যাটোর। আফগানিস্তানে এ রকম সব দেশই দীর্ঘদিন নানাভাবে ছদ্ম শক্তিপরীক্ষায় লিপ্ত আছে।
মধ্য এশিয়ায় যোগাযোগের জন্য আফগানিস্তান ভারতের জন্য জরুরি মাধ্যম। কাশ্মীর থেকে আফগানদের দূরে রাখতেও কাবুলে তাদের থাকতে হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত ও তার মিত্রদের কাছে কোণঠাসা অবস্থা বদলাতে পাকিস্তানের দরকার আফগানিস্তানে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার। এই বিপরীতমুখী স্বার্থ ভারত-পাকিস্তান উভয়ের কাছে তালেবানদের কদর বাড়াচ্ছে।
আফগানিস্তানে বড় ভূমিকায় তুরস্ক ও কাতার
ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র আফগান পরিস্থিতিতে মোটাদাগে সম্পৃক্ত করতে চাইছে তুরস্ক ও কাতারকেও। সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হলে তুরস্ককে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ভার দিতে চায় তারা। ন্যাটোহীন কাবুলে দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সংযোগবিন্দু হবে এই বিমানবন্দর। এটা নিরাপত্তাহীন থাকলে কূটনীতিক বা উন্নয়নকর্মীরা দেশটিকে এড়িয়ে চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহমতো তুরস্কও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। তাদের আঞ্চলিক মিত্র পাকিস্তানেরও এতে হয়তো নীরব সম্মতি রয়েছে। কিন্তু তালেবানরা এতে আপত্তি তুলেছে। ন্যাটো কাতারকেও আফগান পরিস্থিতিতে বাড়তি মাত্রায় যুক্ত করতে চায়। আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণকাজের দায়িত্ব দিতে চায় তারা দোহার হাতে।
এসব উদ্যোগ সফল হলে আফগান পরিস্থিতিতে নতুন দুই শক্তির বড় উপস্থিতি দেখা যাবে শিগগির। একে ন্যাটোর কাজে কাতারের নীরব অন্তর্ভুক্তি হিসেবেও গণ্য করা যায়, যা দেশটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। কাতারে তালেবানদের আনুষ্ঠানিক দপ্তর রয়েছে। আফগান পরিস্থিতিতে তুরস্কের ভূমিকার বিরোধিতা করলেও কাতারকে দূরে রাখার কথা বলতে পারবে না তালেবানরা।
বাংলাদেশ এখন কী করবে?
আফগানিস্তান অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ বহু বছর যাবৎ দূরবর্তী দর্শকের ভূমিকায় আছে। কিন্তু এই যুদ্ধের আঁচ থেকে রেহাই ছিল না তার। অনেক আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠিত ছিলেন। বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট আফগানিস্তান — এই শিরোনামের বইও প্রকাশিত হয়েছে । বাস্তবে মোটেই তেমন কিছু ঘটেনি। এটাই বাংলাদেশের সামাজিক শক্তির জায়গা, যা বুঝতে অনেক আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার ভুল করেন। তবে দেশটিতে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশকে কিছুটা নিরাপত্তা-স্বস্তি দিয়েছিল বটে।
২০১১ সালে কয়েকজন প্রবাসী নির্মাণশ্রমিক অপহরণ করে বাংলাদেশের জন্য এক দফা ভীতি বাড়ায় তালেবানরা। এ রকম অপহরণের লক্ষ্য অবশ্য বাংলাদেশ ছিল না, ছিল উন্নয়নকাজ বন্ধ করা। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সেখানকার নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সম্পৃক্তি চাওয়া হয়। নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ সে অধ্যায় পার হয়েছে। তবে এখন ন্যাটো চলে যাওয়ামাত্র সেখানে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের সতর্ক ও সক্রিয় হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
আফগানিস্তান বাংলাদেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরের দেশ, নিকট প্রতিবেশী নয়। তাই বলে বাংলাভাষীদের সেখানে যাওয়া থেমে ছিল না কখনো। ভবিষ্যতেও সেই ধারা বজায় থাকবে। বাংলাভাষীদের আফগান সংস্কৃতি জানা প্রধানত যে সাহিত্যিকের সূত্রে সেই মুজতবা আলীর সে দেশে থাকার ১০০ বছর পূর্তি হবে আর ছয় বছর পর।
ন্যাটো চলে যাওয়ার পর দেশটির অবকাঠামোগত পুনর্গঠনে প্রচুর মানবসম্পদ লাগবে। পারস্পরিক আন্তবাণিজ্যও বাড়বে। সামাজিক উন্নয়নে এনজিওগুলোর বাড়তি উপস্থিতিরও তাগিদ তৈরি হতে পারে তখন। এসবে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেখানে কাজ করছে। নতুন পরিস্থিতি এসব সংস্থার জন্য একই সঙ্গে অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনা আকারে হাজির হতে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জটি অবশ্যই নিরাপত্তাসংক্রান্ত।
রাশিয়াবিরোধী যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে আফগানিস্তানে বাংলাদেশিদের উপস্থিতির খবর বের হতো বিদেশি সংবাদমাধ্যমে। দেশটিতে তালেবানরা আবারও কর্তৃত্ব পেলে নতুন করে সেখানে বাংলাদেশিদের আসা-যাওয়ায় তদারকির প্রয়োজন পড়তে পারে। বিশেষ করে পাকিস্তানের পাশাপাশি ভারতও যখন তালেবানমুখী অবস্থান নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশের আফগাননীতি সতর্কতার সঙ্গে পুনর্বিন্যাস দাবি করছে বৈকি।
তালেবানরা যদি কাবুলে চালকের আসনে চলে আসে, তাহলে সার্কের সদস্য হিসেবে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দেখাসাক্ষাতের অনিবার্য এক বাস্তবতা আসন্ন। সার্কের অভ্যন্তরীণ সমীকরণেও তালেবান নিয়ন্ত্রিত কাবুল নতুন উপাদান যুক্ত করবে। কাবুলে বাংলাদেশ মিশনের সক্রিয় হয়ে ওঠার চাহিদা তৈরি হয়েছে এসব কারণেই।
সৈয়দ মুজতবা আলী ৯৪ বছর আগে যেখানে ‘রেকি’ করে এসেছেন, সেখানে আমাদের সংকোচে বিহ্বল হয়ে থাকা মানে পিছিয়ে পড়া। আফগানিস্তান নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণটি মুজতবা আলীই লিখে গেছেন, ৩৯৪ পৃষ্ঠার দেশে বিদেশের শেষ অনুচ্ছেদে স্থানীয় বন্ধুর বিবরণ দিতে গিয়ে: আব্দুর রহমানদের হৃদয় বরফের চেয়েও শুভ্র।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ক গবেষক