সম্প্রতি ঢাকার এক উল্লেখযোগ্য স্কুলের গেটে দেখা এক সহকর্মীর সঙ্গে। খুবই রাগান্বিত ও উত্তেজিত তিনি; পাশে তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি বাবার এহেন অবস্থায় খানিকটা লজ্জিত ও ম্লান। আমাকে পেয়েই সহকর্মী তাঁর রাগ ও উত্তেজনার ঝাঁজ খানিকটা প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন। ব্যাপার কী? ব্যাপার আর কিছু নয়—সহকর্মীটির মেয়ে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে ভালো ফল করেই উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি মেয়েকে স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন নবম শ্রেণীতে মানবিক শাখায় ভর্তি করাবেন বলে। কিন্তু স্কুলে এসে জানা যায়, ওই স্কুল থেকে মানবিক শাখা আগের বছরই তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা (বাণিজ্য) শাখায় ভর্তি চলছে। আমিও অবাক! জিজ্ঞেস করলাম: এখন উপায়? উপায় আবার কী? সহকর্মীটির উত্তেজনা তখনো ফুরিয়ে যায়নি। বললেন: আগামীকাল এসে মেয়েকে হয়তো তিনি বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি করাবেন। কিন্তু একাদশ শ্রেণীতে মেয়েকে তিনি মানবিক শাখাতেই পড়াবেন, তা সে যে প্রতিষ্ঠানেই হোক!
‘তা সে যে প্রতিষ্ঠানেই হোক’—কথাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর পুরো ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের উচ্চশিক্ষার এক ফাঁপা সত্য। সত্যি, ঢাকার তথাকথিত নামীদামি স্কুল ও কলেজ থেকে মানবিক শাখায় পঠনপাঠন আশঙ্কাজনকভাবে উঠে যাচ্ছে। সবাই ঝুঁকছে ব্যবসায় শিক্ষা (বাণিজ্য) ও বিজ্ঞান শাখায় পড়ার দিকে। অথচ, তারা খোঁজ নিচ্ছে না এসএসসি বা এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষায় তার প্রিয় সন্তানটির জন্য সারা দেশে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে কতগুলো আসন রয়েছে? আমাদের স্কুল-কলেজগুলোও বোধ করি উচ্চশিক্ষার প্রকৃত অবস্থা বিদ্যার্থীদের সামনে তুলে ধরতে সফল হচ্ছে না, যে অবস্থা তুলে ধরলে বিদ্যার্থীরাই বুঝে যাবে পরবর্তীকালে কোন শাখায় তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আজকের বাস্তবতা হলো, ঢাকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য স্কুল-কলেজে মানবিক শাখার পঠনপাঠন প্রায় উঠে গেছে, দু-একটিতে থাকলেও বিদ্যার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা।
আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, গত শতকের সত্তর বা আশির দশকে—তখনো বিজ্ঞান, বাণিজ্য, মানবিক এই তিন শাখায়ই মুখ্যত ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতো। সে সময় অবশ্য বিজ্ঞান আর মানবিক শাখার প্রতি সবার আগ্রহ ছিল বেশি। এর কারণও ছিল। প্রথমত, সমাজবিকাশে বিজ্ঞান ও মানবিক শাখার গুরুত্ব; দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষায় এ দুটি শাখার উন্মুক্ত দ্বার।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মুক্তবাজারের বদৌলতে বাণিজ্যশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই শাখার নাম বাহারিভাবে পাল্টে যায়; হয় বাণিজ্য থেকে ‘ব্যবসায় শিক্ষা’। এই আগ্রহ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবসায় শিক্ষা শাখার বিদ্যার্থীদের পঠনপাঠনের আসন বৃদ্ধি বা পরিধি প্রসারিত হয়েছে—এমন বলা যাবে না; বিশেষ করে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। সরকারি অনুদানে পরিচালিত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে রেখে বুঝে নেওয়া যাক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক শাখায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুযোগ কতটা রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় উত্তীর্ণ হলে কোনো বিদ্যার্থী বিজ্ঞান অনুষদের সাতটি, জীববিজ্ঞান অনুষদের দশটি, ফার্মেসি অনুষদের তিনটি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের চারটি, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের চারটি বিভাগসহ কয়েকটি ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারে। তা ছাড়া ইউনিট পরিবর্তন করেও বিজ্ঞান শাখার বাইরে প্রায় এক হাজার আসনে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিজ্ঞান শাখা থেকে উত্তীর্ণদের জন্য।
আর উচ্চমাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীরা বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের আটটি বিভাগে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গ’ ইউনিটে অর্থাৎ ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের মাধ্যমে এবার মাত্র এক হাজার ১৭৫ আসনে ভর্তি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শাখা পরিবর্তন করার ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে কিছু আসনে তারা ভর্তি হতে পারে। গত বছর যেখানে সারা দেশে উচ্চমাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষায় দুই লাখ ১৫ হাজার ৩১৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছে, সেখানে এক হাজার ১৭৫ আসন খুবই অপ্রতুল নয় কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তবু আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০০টি আসন বৃদ্ধি করেছে। তার পরও এই বিপুলসংখ্যক উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীর বিপরীতে তা সামান্যই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য আসনসংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই কৃতকার্যদের অনেকেই অধিক টাকা ব্যয়ের কথা জেনেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ধাবিত হয় বাধ্য হয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক শাখায় আসনসংখ্যা সেদিক থেকে প্রায় দ্বিগুণ: দুই হাজার ৩০০-এর বেশি। উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদভুক্ত ১৬টি বিষয়, সামাজিক অনুষদভুক্ত ১২টি বিষয় ছাড়াও আইন, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে ভর্তির সুযোগ গ্রহণ করা যায়। অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, নৃবিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি আকর্ষণীয় বিষয়ে প্রধানত উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক শাখার শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। এখান থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করার পর, প্রয়োজন হলে কেউ যদি জীবিকার জন্য এমবিএ ডিগ্রি করে নেয়, তাহলে তার অবস্থা কোনো দিক থেকেই খারাপ হয় না। অর্থনীতি, ইংরেজি, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে অনেকেই বড় বড় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
এই সত্যটি না জানার কারণে ঢাকা তো বটেই, অন্য শহরগুলোতেও মানবিক শাখায় পঠনপাঠনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। চাকরি ও উচ্চশিক্ষার অধিকতর সুযোগের কথা ছেড়ে দিলেও বলা প্রয়োজন, সুশীল সমাজ গঠনের জন্য মানবিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই স্কুল-কলেজে মানবিক শাখায় পঠনপাঠন কমে যাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।
ড. সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
scpcdu@gmail.com